
প্রিন্ট: ০৭ জুলাই ২০২৫, ০৯:১৭ এএম
দূষণে বিপর্যস্ত মেঘনা, মরছে মাছ, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র ও জীবিকা

চাঁদপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫, ০২:২৩ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার মেঘনা নদীতে আবারও দেখা দিয়েছে ভয়াবহ জলজ পরিবেশ সংকট। বিষাক্ত বর্জ্য ও কেমিক্যালযুক্ত পানি মিশে নদীর পানির গুণগতমান মারাত্মকভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। এর প্রভাবে নদীর দেশীয় প্রজাতির মাছ গণহারে মারা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই জাটকা, বেলে, চাপিলা, টেংরা, চেউয়া, পুঁটি সহ নানা প্রজাতির ছোট-বড় মাছ মরে ভেসে উঠতে শুরু করেছে।
শুক্রবার (১৬ মে) ভোর থেকে মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে দশানি পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে নদীতে ভেসে থাকা মরা মাছের দৃশ্য আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে নদীপাড়ের মানুষদের মধ্যে। নদীর তীরে এখন পঁচা মাছের দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ ও মৎস্য সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয় জেলে ও বাসিন্দারা বলছেন, কয়েক বছর ধরে এমন ঘটনা ঘটলেও এখনো পর্যন্ত নেওয়া হয়নি কার্যকর কোনো ব্যবস্থা।
ষাটনল এলাকার জেলে পলাশ বর্মন বলেন, নদীটাই আমাদের জীবনের অংশ। কিন্তু এখন সেখানে শুধু বিষ। মাছ নেই, বরং বিষে ভরে গেছে। জাটকা সহ অনেক মূল্যবান মাছ মারা যাচ্ছে। এমন চলতে থাকলে নদী থেকে একসময় মাছই হারিয়ে যাবে।
দশানি এলাকার গৃহবধূ সেলিনা বেগম বলেন, আমরা সব সময় এই নদীর পানি ব্যবহার করি, কিন্তু এখন ঘরের কাজেও এই পানি ব্যবহার করতে পারছি না। এমনকি বাচ্চারা পানিতে নামলেও ভয় হয় চর্মরোগে আক্রান্ত হবে।
স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী মাসগুলোতে নদী থেকে মাছ পাওয়া কঠিন হবে। এতে বাজারে মাছের দাম বাড়বে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস বলেন, এটি নিছক মাছ মরার ঘটনা নয়, এটি একটি জলজ পরিবেশগত দুর্যোগ। শীতলক্ষ্যা নদী থেকে আসা দূষিত পানির স্রোত এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। গত বছরও এমন ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু এবার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চাঁদপুর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান জানান, এ বছরের জানুয়ারিতে গঠিত তদন্ত কমিটি জানায়, নদীর পানিতে অ্যামোনিয়ার মাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে মাছের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া নদীর তলদেশ দিয়ে আসা বর্জ্য ও কেমিক্যাল দূষণের বড় কারণ। নতুন করে ঘটনার তদন্ত করা হবে।
স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ‘মতলবের মাটি ও মানুষ’-এর সভাপতি শামীম খান বলেন, এই নদী হাজারো মানুষের জীবিকার উৎস। দূষণ শুধু পরিবেশ নয়, অর্থনীতির ওপরও আঘাত হানছে। দ্রুত আন্তঃজেলা পরিবেশ কমিশন গঠন এবং দায়ী শিল্পকারখানার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
কলাকান্দা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো. শামসুদ্দিন বলেন, নদীকে ঘিরে শত শত মানুষ বেঁচে আছে। কিন্তু বারবার অভিযোগ করেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। নদী না বাঁচলে আমরা কেউ বাঁচব না—এটাই এখন সবার মূল দাবি হওয়া উচিত।
বারবার দূষণে মেঘনা নদী আজ মৃতপ্রায়। এ নদীর ওপর নির্ভরশীল হাজারো জেলে, মাছ ব্যবসায়ী ও নদীপাড়ের পরিবারগুলোর জীবন-জীবিকা এখন হুমকির মুখে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে বড় ধরনের মানবিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় অনিবার্য।