Logo
Logo
×

মতামত

বিদেশে সমাধিস্থ যোদ্ধার দেশে ফেরা, জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে তারা

Icon

বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:২১ এএম

বিদেশে সমাধিস্থ যোদ্ধার দেশে ফেরা, জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে তারা

কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্র, ময়নামতি, কুমিল্লা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত বিভিন্ন দেশের সৈন্যরা যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত। ২০২৪ সাল, মধ্য হেমন্তের এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল ভোরবেলা। নিথর বাতাস।

গ্রীষ্মকালের মতো গরম। বৃক্ষরাশির গাঢ় ছায়ায় একদল জাপানিজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। কাজ শুরুর আগে তারা নীরবে প্রার্থনা করছেন। কয়েকজন বাংলাদেশিও পাশে আছেন, যাদের অন্যতম লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীরপ্রতীক)।

প্রার্থনা শেষে কবরস্থানের ছোট পরিসরের যে জমিটিতে তারা একত্রিত হলেন তা চোখে পড়ার মতো কিছু নয়, কিন্তু তার মাটির নিচটা ইতিহাসে ভরপুর। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ইতিহাস খুঁড়ে আনার কাজ শুরু হয়ে গেল। উয়েদা তাদাও (Ueda Tadao) এবং ওয়েমুরা (Oemura) নামাঙ্কিত দুজন জাপানিজের ফলক কবর থেকে সরিয়ে রাখা হলো। মাটি খননের যন্ত্র ধীরে ধীরে ওপরের স্তর সরিয়ে ফেলল।

তারপর আয়তাকার কয়েকটি গর্ত করা হলো; এক থেকে দেড় মিটার গভীর। ২৩ বছর বয়সী জাপানি শিক্ষার্থী সেইকি মিজোবে (Seiki Mizobe) গর্তে নেমে গেলেন। জাপান ইয়ুথ রিমেইনস কালেকশন গ্রুপ (JYMA) একটি ছাত্রসংগঠন, যা জাপান এবং বিদেশে দেহাবশেষ সংগ্রহের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে, মিজোবে তার একজন সদস্য। মিজোবের সাথে বাংলাদেশের কয়েকজন কর্মীও গর্তে নেমে কাজ করতে লাগলেন। শুরু হলো নিঃশব্দ হস্তক্ষেপে, গভীর যত্নে আরো গভীরে খোঁড়ার কাজ।

দেহাবশেষ যতটা সম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত না করার জন্য জাপান থেকে আনা বাঁশের স্প্যাচুলা, স্কিউয়ার, ব্রাশ ইত্যাদি দিয়ে সাবধানে মাটি পরিষ্কার করা হচ্ছিল। দেহাবশেষ অক্ষত অবস্থায় তুলে আনা কঠোর শারীরিক পরিশ্রম এবং হাতের কোমল স্পর্শের কাজ। একসময় মাটির নিচ থেকে উঁকি দিল একটি মরদেহের হাঁটুর গোল অংশ। বাংলাদেশি কর্মীরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। ৮০ বছর ধরে মাটিচাপা পড়ে থাকা হাড়গুলো শুকনা কাঠের মতো বাদামি। ফিমার হাড় ভেঙে গেছে। আঙুল ও পাঁজরের ছোট হাড়গুলো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। যে কফিনে দেহটি রাখা হয়েছিল, তার ধাতব অংশ ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। তবু দেহটি এখনো সেই ভঙ্গিতেই শুয়ে আছে, যেভাবে তাকে শায়িত করা হয়েছিল। মানব-অবয়বের সেই আকার এখনো জীবন্ত। সেই দিকে তাকিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে মিজোবে অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘আপনারা অনেক অপেক্ষা করেছেন, অর নয়, এখন আপনাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে।’ 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে প্রায় ৮০ বছর আগে। তবু সেই যুদ্ধের পদধ্বনি ও রক্তাক্ত স্মৃতি এখনো বহু জাতির হৃদয়ে গভীর ছাপ হিসেবে রয়ে গেছে। এমনকি যারা পরাজিত হয়েছিল, যারা বিদেশের মাটিতে প্রাণ হারিয়েছিল, তাদের স্মৃতিও আজও মূল্য পায় নিজ দেশের কাছে। এরই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো জাপান সরকারের উদ্যোগে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত জাপানি সেনাদের দেহাবশেষ সংগ্রহ করে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া। ময়নামতি কবরস্থানে নিজেদের সৈন্যদের সমাহিত থাকার বিষয়টি জাপানিজদের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই জানা ছিল এবং দেহাবশেষ সংগ্রহ অভিযান বাস্তবায়নের বিষয়ে জাপান সরকার ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের সাথে আলোচনা করে আসছিল।

জাপানের সংবাদমাধ্যম এনএইচকের তথ্য অনুযায়ী, ওই অর্থবছর থেকে সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি মাঠ জরিপে পাওয়া যায় যে বাংলাদেশে মোট ৪৩ জন জাপানি সৈন্যের কবর রয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে পরিকল্পনাটি সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ সরকার দেহাবশেষ সংগ্রহের অনুমতি প্রদান করে। এনএইচকে সেপ্টেম্বরে সংবাদ প্রকাশ করে যে ওই বছরের নভেম্বর মাসে এই সংগ্রহের কথা রয়েছে। যুদ্ধের আগে বাংলাদেশ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতের অংশ ছিল এবং কুমিল্লায় একটি ব্রিটিশ ফিল্ড হাসপাতাল ছিল। জাপানি সেনাবাহিনী প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন উত্তর-পূর্ব ভারত জয় করার লক্ষ্যে বার্মার (বর্তমানে মায়ানমার) ইম্ফলে নিয়োজিত ছিল। জাপানের স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (এমএইচএলডব্লিউ) মতে, ইম্ফল যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি এবং নিহত জাপানি সৈন্যদের ময়নামতিতে সমাহিত করা হয়েছিল। ময়নামতি কবরস্থান পরিচালনাকারী ‘কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন’ (সিডব্লিউজিসি)-এর রেকর্ড অনুসারে, সেখানে ২৪ জন জাপানি সৈন্য সমাহিত আছেন। তাদের দেহাবশেষ উদ্ধারের কাজ শুরু হয় গত ১৩ই নভেম্বর। ২৪শে নভেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দুই দিন আগেই এই কার্যক্রম সমাপ্ত হয়। ২৪টি সমাধির মধ্যে ২৩টিতেই সৈনিকদের দেহাবশেষের বিভিন্ন অংশ পাওয়া যায়। এগুলো জাপানের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দল নিয়ে গেছেন জাপানে। প্রথমে এদের ডিএনএ টেস্ট হবে। দাবিদার কোনো পরিবারের সাথে মিল পাওয়া গেলে দেহাবশেষ তাদের হাতে সমর্পণ করা হবে। আর দাবিদার কারো সাথে ডিএনএ টেস্ট না মিললে তা পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে টোকিওস্থ অজানা সৈন্যদের কবরস্থানে। বাংলাদেশে এটিই প্রথমবারের মতো জাপানিজ সৈন্যদের দেহাবশেষ সংগ্রহ, যা মূলত দেশটির স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত ‘জাপান ওয়্যার রিমেইনস কালেকশন প্রমোশন অ্যাসোসিয়েশন’ দ্বারা পরিচালিত হয়। জাপানের প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমে সংবাদটি গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়। ‘কুরিয়ার জাপান’ পত্রিকায় সাংবাদিক চিহিরো মাসুহো (Chihiro Masuho) এ নিয়ে একটি চমৎকার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। চিহিরোকে মিজোবে বলেছেন, ‘আমি কেবল পুরানো হাড় খনন করছি না, আমি একটি পতিত আত্মাকে ঘরে ফিরে যেতে সাহায্য করছি। আমি তার উপস্থিতি অনুভব করি। আমি তার জীবনকে সম্মান করি।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সকল পক্ষ মিলিয়ে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ সৈন্য নিহত হয়েছিলেন। জাপানিজ মারা গিয়েছিলেন প্রায় ৩১ লাখ, যার মধ্যে আনুমানিক ২৪ লাখ (বেসামরিক নাগরিকসহ) বিদেশে মারা গিয়েছিলেন। ১১ লাখেরও বেশি জাপানিজের মরদেহ এশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মোতাবেক, বিদেশে মারা যাওয়া জাপানি সৈন্যের মধ্যে প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার দেহাবশেষ ইতোমধ্যে জাপানে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এই ফিরিয়ে আনাকে দুটি কালে বিভক্ত করা যায় :

১. ১৯৪৫-১৯৫২ : আগস্টে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হলেও ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জাপান মার্কিন দখলদারির অধীন ছিল।  এই ৭ বছরে প্রায় ৯,৩২,০০০ দেহাবশেষ জাপানে প্রত্যাবাসিত হয়। প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রসমূহ (যেমন, সাইপান, ফিলিপাইন, ইও জিমা) থেকে মার্কিন বাহিনী, রেড ক্রসের মাধ্যমে অ্যাডহক প্রচেষ্টায় এদের আনা হয় এবং প্রায়ই ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়াই পরিবারের কাছে হস্তান্তর বা গণকবরে দাফন করা হয়। 

২. ১৯৫২-বর্তমান : ১৯৫২ সালে ‘সান ফ্রান্সিসকো চুক্তি’র ফলে জাপানে মার্কিন দখলদারির অবসান ঘটে, জাপানের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার হয়। ওই বছরই জাপান সরকারের উদ্যোগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জকে অন্তর্ভুক্ত করে বিদেশস্থ দেহাবশেষ পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়, পরে যা প্রাক্তন সোভিয়েত অঞ্চল এবং মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। যদিও সব দেশ একে স্বাগত জানায়নি। সংগৃহীত দেহাবশেষের বেশির ভাগের পরিচয়ই অজ্ঞাত ছিল, ডিএনএ পরীক্ষা অভাবে। ফলে পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়নি। 

১৯৬২ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি বন্ধ করার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রবীণ যোদ্ধা এবং শোকাহত পরিবারের বারবার অনুরোধের পর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ২০০৩ সালে জাপান সরকার সীমিত কলেবরে ডিএনএ ম্যাচিং শুরু করে, তবে শুধুমাত্র সম্ভাব্য পরিবারের অনুরোধক্রমে। জাপান জুলাই মাসে মন্ত্রণালয়ে একটি বিস্তৃত ‘দেহাবশেষ তথ্য কেন্দ্র’ স্থাপন করে সেখানে ডিএনএ পরীক্ষার আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা করা হয়। ২০১৬ সালে জাপান সংসদ ‘যুদ্ধে নিহতদের দেহাবশেষ সংগ্রহ সহায়ক আইন’ (The Act on Promotion of Collection of Remains of War Dead) পাস করে, যা পরবর্তী ৮ বছর ডিএনএ পরীক্ষা এবং পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা বৃদ্ধিকে আইনত বাধ্যতামূলক করে, যার মধ্যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হাড় পরীক্ষা এবং মার্কিন সংস্থাগুলির সাথে সমন্বয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। পরবর্তীতে আইনের মেয়াদ ২০২৯ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। ১৯৫২ সাল থেকে জাপান সরকারের ব্যবস্থাপনায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৩,৪০,০০০ দেহাবশেষ জাপানে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এর বাইরে কয়েক হাজার দেহাবশেষ জাপানের মাটি থেকেই পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। ২০০৩ সালে জাপান ডিএনএ ম্যাচিং শুরু করার পর থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত জাপান এবং বিদেশে পাওয়া মোট ৭,০২৬টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১,২৮০টি সেট সফলভাবে শনাক্ত করা হয়েছে এবং পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাকিগুলো, অর্থাৎ ৫,৭৪৬টি ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করা হয়েছে, কিন্তু কোনও পারিবারিক মিল (ডিএনএ বা আর্টিফ্যাক্ট-ভিত্তিক) নিশ্চিত করা যায়নি। এই অজ্ঞাত দেহাবশেষগুলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংরক্ষণাগারে রাখা আছে, এই আশায় যে ভবিষ্যতের উন্নত শনাক্তকরণ পদ্ধতি বা পারিবারিক রেফারেন্সের মাধ্যমে কোনো দিন ইতিবাচক মিল পাওয়া যাবে। ১৯৫২ সালের আগে-পরে যে ১২ লাখ ৮০ হাজার দেহাবশেষ জাপানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে, তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই পরিচয় শেষ পর্যন্ত শনাক্ত করা যায়নি; সংখ্যাটা ৩,৫৮,০০০। এসব অজ্ঞাত দেহাবশেষের চূড়ান্ত বিশ্রামস্থল হয়েছে টোকিওর চিদোরিগাফুচি (Chidorigafuchi) জাতীয় কবরস্থান। 

জাপান সরকার বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় দেহাবশেষ সংগ্রহ করে জাপানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, তা কেবল মানবিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং একটি জাতির আত্মপরিচয় ও ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রকাশ। শুধু জাপান নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু বছর পরেও বিভিন্ন দেশ তাদের নিহত যোদ্ধাদের প্রতি একই রকম দায়িত্ব পালন করে চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সোভিয়েত সেনাদের দেহাবশেষ এখনও পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে খুঁজে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হচ্ছে। বিশেষত লাটভিয়া, পোল্যান্ড ও ফিনল্যান্ডে যুদ্ধকালীন কবরস্থানগুলো থেকে রাশিয়ার সেনাদের ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ চলছে। যদিও নাৎসি বাহিনীর পরাজয়ের কারণে যুদ্ধ-পরবর্তী সময় ছিল জার্মানির জন্য এক কঠিন অধ্যায়, তবু বর্তমান জার্মান সরকার বিভিন্ন দেশে নিহত ও সমাধিস্থ জার্মান সেনাদের স্মৃতিস্তম্ভ রক্ষা করে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে দেহাবশেষ উদ্ধার করে সম্মানজনকভাবে সমাধিস্থ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেসব মার্কিন সেনা ইউরোপ বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিহত হয়েছিলেন, তাদের দেহাবশেষ অনুসন্ধান করে ফিরিয়ে আনার জন্য ডিপিএএ (Defense POW/MIA Accounting Agency) আজও কাজ করছে। প্রায় ৭৯,০০০ মার্কিন সৈন্য নিখোঁজ রয়েছেন। প্রতি বছর গড়ে শতাধিক সৈন্যের দেহাবশেষ শনাক্ত করে ফেরত আনা হচ্ছে। ২০২৪ সালেও ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কয়েকজন সেনার দেহাবশেষ উদ্ধার করে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত আনা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের মতো গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস যে জাতির রয়েছে, সে জাতি এক্ষেত্রেও পিছিয়ে থাকতে পারে না। বাংলাদেশে প্রথম যে মুক্তিযোদ্ধার দেহবশেষ বিদেশ থেকে আনা হয়েছে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। ২০ আগস্ট ১৯৭১ শুক্রবার; মতিউর রহমান করাচির মাশরুর বিমান ঘাঁটি থেকে যুদ্ধবিমান টি-৩৩ নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে উড়াল দিয়েছিলেন। এর আগে বিমানের পাইলট পাকিস্তানি ছাত্র রশিদ মিনহাজকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলেছিলেন। বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মতিউর রহমান ছুটে চললেন। রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য নির্ধারিত উচ্চতার চেয়ে অনেক নিচ দিয়ে বিমান চালাচ্ছিলেন তিনি। ততক্ষণে এফ-৮৬ যুদ্ধবিমান ও একটি হেলিকপ্টার তাকে ধাওয়া করে। পাক-ভারত সীমান্ত থেকে মাত্র দুই মিনিট দূরত্বে সিন্ধু প্রদেশের থাট্টা এলাকায় বিধ্বস্ত হয় তাঁর বিমানটি। নিহত মতিউর রহমানকে দাফন করা হয় মশরুর বিমানঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কবরস্থানে। কবরে লেখা ছিল ‘ইধার সো রাহা হ্যায় এক গাদ্দার’ (এখানে ঘুমিয়ে আছে এক গাদ্দার)। ৩৫ বছর পাকিস্তানের মাটিতে তার কবর পড়েছিল অপমান আর অনাদরে। দীর্ঘ কূটনৈতিক তৎপরতা শেষে ২০০৬ সালের ২৪ জুন মতিউরের দেহাবশেষ তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। রাজধানীর জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে সকালে বিশেষ প্রার্থনা শেষে পরদিন ২৫শে জুন পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাঁকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শেষবারের মতো দাফন করা হয়। 

এরপর যে মুক্তিযোদ্ধার দেহাবশেষ বিদেশ থেকে দেশে আনা হয় তিনিও একজন বীরশ্রেষ্ঠ। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১৭ বছর বছরের কিশোর সিপাহি হামিদুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর মৌলভীবাজারের ঐতিহাসিক ‘ধলই যুদ্ধে’ শহীদ হন, যেখানে তিনি অসাধারণ সাহসিকতা প্রদর্শন করেন; পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১টি মেশিনগান পোস্ট গ্রেনেড দিয়ে ধ্বংস করেন, তার পরপরই দ্বিতীয় মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড নিক্ষেপের আগে প্রতিপক্ষের গুলিবর্ষণে শহিদ হন। প্রথমে তার দেহাবশেষ যুদ্ধক্ষেত্রের কাছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমারাছড়ার একজন সম্ভ্রান্ত গ্রামবাসী লোকমান মিয়ার পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। জমির মালিকানা বদল হলেও কয়েক দশক ধরে তিনি সেখানেই ঘুমিয়ে ছিলেন। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের মাধ্যমে ১০ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে তার দেহাবশেষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। পরদিন জাতীয় সম্মান এবং আবেগঘন শ্রদ্ধাঞ্জলির মধ্য দিয়ে হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। প্রত্যাবাসন অভিযানের নেতৃত্ব দেন পূর্বল্লিখিত জাপান মিশনে অংশগ্রহণকারী লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীরপ্রতীক), পুরো অভিযানটি তিনি ‘বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের দেশে ফেরা’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। 

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেয়নেটের আঘাতে শহীদ কুড়িগ্রাম কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক আবদুল ওয়াহাব তালুকদার পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার অন্তর্গত বগনী নদীর কিনারে কালমাটি মসজিদ চত্বরে (ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার পিলার নং ৯৫৪ সংলগ্ন) সমাহিত আছেন। এর বাইরেও অনেক নাম না-জানা মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর মাটির ঘরে চিরনিদ্রাভিভূত হয়ে আছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্গত শিলংয়ে ছিল ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একটি কমান্ড হাসপাতাল। মুক্তিবাহিনীর গুরুতর আহত অনেক যোদ্ধা চিকিৎসার জন্য শিলং দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তাদের কেউ কেউ পথিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন। যারা হাসপাতাল অব্দি পৌঁছুতে পেরেছিলেন ভারতীয় সামরিক ডাক্তাররা তাদের জীবন রক্ষার জন্য জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অনেক মুক্তিযোদ্ধাই বেঁচে থাকতে পারেননি; তারা নিজেদের বা পরিবারের সদস্যদের নাম বলার সময়টুকুও পাননি, সাথে কোনো আইডি কার্ডও ছিল না। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স ছিল ১৮-২৫ বছর। স্থানীয় দুই ভাই আহমেদ হোসেন এবং আফজাল হোসেনের পূর্বপুরুষগণ শিলংয়ের মাওপ্রেম (Mawprem)-এ নিজেদের জমিতে কবরস্থান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে শিলং আর্মি হাসপাতালে নিযুক্ত একজন কর্নেল একটি সভা আহ্বান করেন; তিনি ওই দুই ভাইকে গোপনীয়তা এবং সতর্কতার সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের দাফন কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। দুই ভাই সেভাবেই মাওপ্রেম কবরস্থানে মুক্তিবাহিনীর মোট ৫২ জন সদস্যকে মুসলিম রীতি অনুসরণ করে সমাহিত করেছিলেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার দুই ভাইকে ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার অ্যাওয়ার্ড’ দিয়ে ভূষিত করে। কিন্তু ওই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম-পরিচয় আজও জানা যায়নি, একটা স্মৃতিস্তম্ভও সেখানে করা হয়নি। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ছিল পরাজিত ‘অক্ষশক্তি’র একটি দেশ। তবু তারা আজও পিছন ফিরে ক্ষতস্থানের দিকে তাকায়। যুদ্ধের সময় জাপানি সৈন্যরা যে মানসিক আঘাতের শিকার হয়েছিলেন তার একটি প্রদর্শনী এই গত ২৩ জুলাই টোকিওর চিয়োদা ওয়ার্ডে শুরু হয়েছে। আহত এবং অসুস্থ অবসরপ্রাপ্ত সৈন্যদের উপকরণ প্রদর্শনের হল ‘শোকেই-কানে’ এই প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয়েছে। যুদ্ধের সময় পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD)-এর মতো মানসিক অবস্থার শিকার সৈন্যদের অস্তিত্ব দীর্ঘকাল গোপন রাখা হয়েছিল। সৈন্যদের পরিবারের সাক্ষ্যের প্রতিক্রিয়ায়, সরকার গত অর্থবছরে সামরিক হাসপাতাল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত চিকিৎসা রেকর্ড এবং ব্যক্তিগত হিসাব সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে প্রথমবারের মতো জাতীয় জরিপ পরিচালনা করে। ‘মানসিক ক্ষত বহনকারী সৈনিক’ শিরোনামের এই প্রদর্শনীতে ওই গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। এটি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে স্থায়ী প্রদর্শনীতে পরিণত হওয়ার কথা রয়েছে। 

এসব ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, একটি সভ্য জাতি তার অতীতকে ভুলে যায় না। একসময় যারা নিজ দেশের জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন, ইতিহাস যেভাবেই তাদের মূল্যায়ন করুক না কেন, স্বদেশ তাদের স্মৃতিকে ধরে রাখে শ্রদ্ধাভরে। বাংলাদেশ থেকে জাপানি সেনাদের দেহাবশেষ ফেরত যাওয়ার ঘটনা শুধু জাপানের জন্য নয়, আমাদের জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বয়ে আনে। শিলং তথা বিদেশের অন্যান্য স্থানে সমাহিত যে সকল মুক্তিযোদ্ধা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অধিকার রাখেন, তাদের জন্য উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। জীবন যারা ইতিহাস বদলে দিয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সময় ও জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে। মানবতা, ইতিহাস এবং স্মৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা আমাদেরও গভীরভাবে ভাবায়। আমাদের ইতিহাস শুধুই বিজয়ের নয়, সম্মানেরও। আর একটি জাতি অতীতকে কেমনভাবে স্মরণ করে, তার মধ্যেই নিহিত থাকে তার বর্তমান ও ভবিষ্যতের পরিচয়। একটি জাতির চরিত্র কেমন, তা শুধু বিজয়ের মধ্যেই নয়, অতীতকে কিভাবে স্মরণ করে, সেটিতেও নির্ধারিত হয়।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, গীতিকবি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, [email protected]

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন