
প্রিন্ট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:৫৩ এএম
সামরিক বাহিনীর প্রতি নাগরিক সমালোচনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ

মেজর (অব.) এ কে এম শাকিল নেওয়াজ
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ১০:৩৪ এএম

আমি অত্যন্ত মর্মাহত হই যখন দেখি কিছু সাধারণ নাগরিক সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে বলে—“তারা মৃতদেহ গোপন করেছে।” এই ধরনের মন্তব্য সাধারণত বিদ্বেষপ্রসূত নয়; বরং দুর্যোগ পরিস্থিতিতে সমন্বিত ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব থেকেই এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
দুর্যোগকালে সমন্বিত মিডিয়া সেলের অপরিহার্যতা:
বড় ধরনের কোনো দুর্যোগের প্রারম্ভেই একটি সমন্বিত মিডিয়া সেল গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। এই সেলে অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়
সিটি কর্পোরেশন
সেনাবাহিনী
বিমান বাহিনী ( এই ঘটনার জন্য)
পুলিশ
ফায়ার সার্ভিস
সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃপক্ষ
এই মিডিয়া সেল প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে একটি যৌথ প্রেস ব্রিফিং আয়োজন করে জনগণকে নিম্নলিখিত বিষয়ে সুনির্দিষ্ট, সমন্বিত ও দায়িত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করবে—
১. দুর্ঘটনার সঠিক সময়
২. হতাহতের সংখ্যা
৩. নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা
৪. আর্থিক ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
৫. উদ্ধার কার্যক্রমের অগ্রগতি ও সমাপ্তির সময়সীমা
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির সময় যদি শুরুতেই এই ধরনের একটি সেল গঠিত হতো, তাহলে আজকের বিভ্রান্তি, গুজব এবং সেনাবাহিনীকে ভুলভাবে উপস্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হতো না।
ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেম (ICS) অনুসরণে ঘাটতি:
এই দুর্ঘটনায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেম (ICS) বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে দেখা গেছে—
বিভিন্ন সংস্থা স্বতন্ত্রভাবে কাজ করেছে
পৃথক বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়েছে
একে অপরের সাথে সমন্বয়হীনভাবে কৃতিত্ব দাবি করেছে
এই বিশৃঙ্খল পরিবেশ থেকেই ভুল তথ্য ছড়িয়েছে এবং কিছু মহল ইচ্ছাকৃতভাবে সেনাবাহিনীকে দায়ী করার সুযোগ পেয়েছে।
বেসামরিক অংশীদারদের দৃশ্যমান অনুপস্থিতি:
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো যাঁরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নীতিগত ও সমন্বয়মূলক নেতৃত্ব দেওয়ার কথা, যেমন:
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা
সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধি
জেলা প্রশাসন
পুলিশ প্রশাসন
সংশ্লিষ্ট সচিব ও আমলারা
গবেষনা প্রতিষ্ঠান সমূহ
তাঁদের উপস্থিতি মিডিয়া ব্রিফিংয়ে অনুপস্থিত ছিল, যা জনগণের আস্থাকে আরও দুর্বল করে।
কাঠামোগত ঘাটতি ও দায়িত্ব জ্ঞান:
সেনাবাহিনীর উচিত এই কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা এবং সংশ্লিষ্ট বেসামরিক অংশীদারদের দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা। অন্যথায় ভবিষ্যতে একই ধরনের বিশৃঙ্খলা বারবার দেখা দেবে।
SOD ও ক্লাস্টার সিস্টেম অনুসরণ অত্যন্ত জরুরি:
প্রত্যেকটি সংস্থার, বিশেষত সেনাবাহিনীর, Standing Orders on Disaster (SOD) এবং Cluster Coordination System সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা ও তা অনুসরণ করা আবশ্যক। এই কাঠামো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নির্দিষ্ট দায়িত্ব বণ্টন ও আন্তঃসংস্থা সমন্বয় নিশ্চিত করে।
নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের তালিকা সংগ্রহে ব্যর্থতা:
মাইলস্টোন স্কুল দুর্ঘটনার পর নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের একটি লিখিত ও আনুষ্ঠানিক তালিকা কেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়নি, তা সত্যিই অগ্রহণযোগ্য। যেহেতু এটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঘটনা, তাই নিখোঁজদের তালিকা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার করা উচিত ছিল।
সামরিক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পার্থক্য স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা জরুরি;
সেনাবাহিনীর অপারেশন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা—এই দুইটি ভিন্ন ক্ষেত্র। এখানে ব্যবহৃত হয়—
আলাদা কৌশল
আলাদা যোগাযোগ কাঠামো
আলাদা সমন্বয় ব্যবস্থা
এই বাস্তবতাকে সম্মান জানিয়ে আমাদের উচিত দুর্যোগ মোকাবেলায় আরও পেশাদার, দায়িত্বশীল এবং সমন্বিতভাবে কাজ করা।
ট্র্যাজেডিতে দায়িত্ব ও কর্তব্যের স্পষ্ট ব্যাখ্যা:
(Standing Orders on Disaster – SOD অনুযায়ী)
দুর্যোগে কেবল সেনাবাহিনী বা কোনো একক সংস্থাকে দোষারোপ না করে, বরং কাঠামোগত ঘাটতি ও সমন্বয় ব্যর্থতা কোথায় ছিল তা বিশ্লেষণ করাই অধিক যৌক্তিক ও কার্যকর।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার তিনটি স্তর:
১. কৌশলগত স্তর (Strategic Level)
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়
জাতীয় নীতিনির্ধারণ, নির্দেশনা প্রদান ও সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব।
পরিচালনাগত স্তর (Operational Level)
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর (DDM)
মাঠপর্যায়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, রেসপন্স টিম সক্রিয়করণ ও সংস্থা সমন্বয়।
মাঠপর্যায় / ট্যাকটিকাল স্তর (Tactical Level)
জেলা প্রশাসক (DC) অথবা সিটি মেয়র
ইনসিডেন্ট কমান্ডার হিসেবে সরাসরি উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনার দায়িত্ব।
সহযোগী সংস্থার ভূমিকা:
ফায়ার সার্ভিস: সরাসরি উদ্ধার কার্যক্রম
ইউটিলিটি সংস্থা: গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি ঝুঁকিমুক্ত করা
পুলিশ: নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও ভিড় নিয়ন্ত্রণ
চিকিৎসা দল: আহতদের চিকিৎসা ও ট্রায়াজ
অ্যাম্বুলেন্স: দ্রুত স্থানান্তর
সেনাবাহিনী: সহায়ক শক্তি হিসেবে SOD অনুযায়ী কাজ করে
সেনাবাহিনী কখন মোতায়েন হয়?
Standing Orders on Disaster (SOD) অনুযায়ী, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় কেবল তখনই, যখন বেসামরিক সংস্থাগুলো ব্যর্থ হয় অথবা পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অর্থাৎ, তাদের ভূমিকা সহায়ক (supporting), প্রধান নয়।
বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন জরুরি:
এই প্রেক্ষাপটে, মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির দায়ভার যদি কারো উপর পড়ে, তা হলে তা মূলত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট বেসামরিক অংশীদারদের উপর। অথচ কিছু মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করছে, যা একদিকে দায়িত্বহীন এবং অন্যদিকে রাষ্ট্রের পেশাদার কাঠামোকে আঘাত করার নামান্তর।
উপসংহার: আত্মসমালোচনার ভিত্তিতে কাঠামোগত পরিবর্তনের ডাক
যদিও পরবর্তীতে দৃশ্যত কিছু ভুল কার্যক্রমকে কর্তৃপক্ষ দ্বারা শুধরানোর চেষ্টা হয়েছে কিন্তু তথাপিও এখন সময় এসেছে দোষারোপের রাজনীতি থেকে সরে এসে, কাঠামোগত ঘাটতি ও সমন্বয় দুর্বলতা চিহ্নিত করে একটি পেশাদার, দায়িত্বশীল ও শক্তিশালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলার। তবে এটাও সত্যি কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই সচেতনতা ও আত্মসমালোচনার চর্চাই ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তিশালী, জনভিত্তিক এবং কার্যকর প্রস্তুতির পথ দেখাবে।
লেখক:
মেজর (অব.) এ কে এম শাকিল নেওয়াজ
ফায়ার ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ
সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স