গত বছর জুলাই মাসে আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল, ধাবিত আন্দোলন দ্রোহ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের পর অকাতরে সাহসী আত্মহুতি দেশকে এক মুক্তির প্রান্তে পৌঁছে দেয়। সার্বভৌমত্ববিরোধী দখলদার ফ্যাসিস্ট পালিয়ে যায়। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষের জনগণের বিজয় হয়। সেই ধেয়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী আন্দোলন তথা আকাঙ্ক্ষা যুক্ত বিপ্লবের একটা সুনির্দিষ্ট নাম থাকা দরকার– হতে পারে সেটা জুলাই রেভ্যুলিউশন বা সংক্ষেপে জুলরেভ (JULREV)।

দেখতে দেখতে সেই রাহুমুক্তি মাহেন্দ্রক্ষণের বর্ষপূর্তি এগিয়ে আসছে। ধাবিত হওয়া আন্দোলন যখন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় তখন আমরা কিছু সামরিক অবসরপ্রাপ্তরা তাদের সঙ্গে জুটে যাই। সে সময়ের স্মৃতি রোমাঞ্চকর এবং ছিল অনাগত আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা। জমে থাকা দ্রোহ আমাদের সবাইকে একসঙ্গে রাস্তায় নিয়ে আসে আর সন্তানতুল্য ছাত্রদের আন্দলনে সমব্যথী, সমর্থক এবং শেষে সতীর্থ করে নেয়। আমরা পরিণতি অনুধাবন না করে আন্দলনের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে মুক্তির মোহনায় পৌঁছে যাই। সেই অগ্নিঝরা রক্তস্নাত দিনগুলো প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে পেছনে পড়ে যাচ্ছে– ফিকে হতে থাকা ঘটনা মনে রাখার চেষ্টা করাই এ লেখার উদ্দেশ্য।
বলা হয় জুলাই বিপ্লবের প্রথম অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চার হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ১৬ জুলাই ’২৪ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী ছাত্র আবু সাঈদ প্রধান ফটকে জান্তা পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে আত্মাহুতি দেওয়ার পর ক্ষোভের আগুন সর্বময় ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ এবং ১৮ জুলাই ’২৪ রাজপথে আপামর ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ ছাত্রলীগ-যুবলীগ হেলমেট লীগের সম্মিলিত সাঁড়াশি আক্রমণ এবং তার প্রতিরোধের প্রেক্ষিতে ১৯ জুলাই থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা আসে । আবু সাঈদের জীবন মহা-আত্মাহুতি কোটা আন্দোলনকে এতটাই আন্দোলিত করে যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যারা অসম এবং অর্বাচীন কোটার কারণে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত তারাও রাস্তায় নেমে আসে, রাজপথে গড়ে তোলে দুর্বার প্রতিরোধ ।
আর দ্বিতীয় প্রাণের জোয়ার আসে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও পরিবারবর্গের ছাত্র গণআন্দোলনে সংহতি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ তথা প্রতিরোধে। ১৮ জুলাই ’২৪ রাতে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং আবাসিক হল খালি করার ঘোষণা আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শুরু হয় পান্ডালিগ ও পুলিশের নিপীড়ন। মিরপুর সেনানিবাসস্থ মিলিটারি স্কুল অফ টেকনোলজি এবং ইউনিভারসিটি অব প্রফেশনালেও সে আদেশ কার্যকর হয়। সে রাতেই সেনানিবাসের গেটসমূহ মোটামুটি দুর্গের সাজ নেয়, এপিসিও লাগান হয় কোথাও কোথাও । হটাৎ করে ফ্যাসিস্ট আদেশের কারণে ১৯ জুলাই খুব সকালে ছাত্রছাত্রীরা ব্যাগ-সুটকেসসহ থম্থমে রাস্তায় অসহায় হয়ে পড়ে। তারা মিরপুর-১২ নম্বরের মাথায় স্টাফ কলেজ গেট এবং মিরপুর ডিওএইচএস গেটে আসতে থাকে যানবাহনের খোঁজে । ব্যাগব্যাগেজসহ যানবাহনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের ওপর তখন পুলিশ আর স্থানীয় সংসদ সদস্যের পান্ডাবাহিনী একযোগে আক্রমণ করে বসে। হতচকিত ছাত্রছাত্রীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। অনেকেই দৌড়ে ডিওএইচএস-এর মধ্যে ঢুকে গলিতে গলিতে দৌড়াতে থাকে । স্বাভাবিকভাবে অত সকালে বাসার গেটগুলো বন্ধ থাকায় পান্ডালিগের আক্রমণ থেকে বাঁচতে ছাত্রছাত্রীদের আকুতি-মিনতিতে সংরক্ষিত আবাসিক এলাকার পূর্বপাশ ভারী হয়ে ওঠে। একদিকে পুলিশভ্যান ও অস্ত্রধারী সরকারি দলের পান্ডাদের দাপাদাপি আর অন্যদিকে ভীতসন্ত্রস্ত ছাত্রছাত্রীদের আর্তনাদ ডিওএইচএসবাসীদের চোখের সামনেই ঘটতে থাকে। বাসিন্দারা গেট খুলে ছাত্রছাত্রীদের আশ্রয় দিলে পান্ডারা সে সব বাড়ির ওপর চড়াও হয়। অবসরপ্রাপ্ত অফিসার এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা এই তাণ্ডবের নির্বাক সাক্ষী বা ভিডিও ধারণে নিয়োজিত হলেও কয়েকজন সাহসী অফিসার ব্যক্তিগত অস্ত্র নিয়ে বের হওয়ার ঘটনা ঘটে। বিকালে অ্যাভিন্যু তিন-এর বড় মসজিদে আসরের নামাজে উপস্থিত অফিসারদের মাঝে ক্ষোভ সংক্রমিত হয় । সকলে একযোগে ডিওএইচএস পরিষদে যান এবং সংরক্ষিত এলাকায় পান্ডা ও পুলিশি আক্রমণের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ক্ষোভ সংক্রমিত হতে থাকলে এশার নামাজের সময় মসজিদের বাইরে বড় ক্ষুব্ধ জমায়েত হয় যেখানে কর্নেল আব্দুল হক এবং কয়েকজন বক্তৃতা করেন। তারপর কয়েকশ’ অফিসার ও পরিবারের সদস্য মূল রাস্তায় শোভাযাত্রা করেন।
জুলাই আন্দোলনে প্রথম সংগঠিত আহ্বান আসে কর্নেল আব্দুল হক স্যারের কাছ থেকে- জুলাই মাসের ১৭ তারিখ। স্যারের অ্যাভিন্যু-২, রোড-১৫ , নম্বর-৯৫৭ বাসায় আমরা বেশ কয়েকজন (লে. কর্নেল হাসিনুর রহমান, লে. কর্নেল নওরজ , লে. কর্নেল হাসান, মেজর জাবের, মেজর সাব্বির, মেজর আল আমিন, মেজর শোয়েব আমান, লে. ইমরান কাজল, মেজর নাজিম) উপস্থিত হই বিকালে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জহুর স্যার যোগ দেওয়ায় সকলের অনুপ্রেরণা বৃদ্ধি পায়। আলোচনাতে সকলেই দেশের পরিস্থিতিতে বিশেষ করে বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের ব্যাপক স্বৈরাচারী আচরণে গভীর নিন্দা জ্ঞাপন করার পাশাপাশি ছাত্রদের ন্যায্য আন্দলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করা হয়। বিশেষ করে আওয়ামী অঙ্গ সংগঠনের আগ্রাসী নিপীড়নকে কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যাবে না । উপস্থিত সকলে প্রাথমিক কর্মপন্থা হিসাবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছাত্র আন্দোলনে সহযোগিতা করার এবং সুযোগ থাকলে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সভার বড় প্রাপ্তি ছিল সহমতের অফিসারদের সঙ্গে মিলিত হওয়া এবং স্বৈরাচার প্রতিরোধের প্রথম মনোবল বিনিময়। আমি বুঝতে পারলাম দ্রোহ শুধু আমার মাঝেই দানা বাঁধে নাই আমার সহযাত্রী রয়েছে আরও ।
১৮ জুলাই ২৪ ছিল শুক্রবার । সরকারের স্বৈরাচারী তথা একের পর এক নির্লিপ্ত হত্যাকাণ্ডের ক্ষোভ পৌঁছে গেছে বাড়ি বাড়ি । প্রতিদিন সংক্ষুব্ধ মানুষ যুক্ত হচ্ছে ছাত্রদের সঙ্গে আর স্বৈরাচারী খুনি প্রতিরোধে নেমে যাচ্ছে রাজপথে। সুরক্ষিত বনানী ডিওএইচএস মাঠে মর্নিং ফুটবল চলেছে যথারীতি। শুক্রবারে খেলার পর ছোট মেয়ের আবদারে তিনশ’ ফুটে বের হই। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম স্ত্রী প্রথমবারের মতো স্বৈরাচারের ওপর খুবই সংক্ষুব্ধ এবং মেয়েও জানাচ্ছে ছাত্রদের আন্দলনের প্রতি সহমর্মিতা। আমি সর্বদাই প্রতিবাদী আর সেদিন দুজনের অবাক করা অংশগ্রহণে উৎসাহিত হয়েছি আরেকটু । দ্রোহ অনুরণিত হয়ে দানা বাঁধল- আমি গাড়ি থামালাম প্রথম টানেলের সামনে; স্প্রে পেইন্ট দিয়ে শুরু হলো প্রথম লেখা CHATRALEGUE FREE >> । খয়েরি রঙের স্পেটা পুরাতন গাড়িতেই ছিল মূলত ডেন্ট লুকানোর জন্য। এরপর জয়বাংলা চত্বরে (বর্তমানে শহীদ জিয়া চত্বর) লিখলাম ছাত্রলীগমুক্ত এলাকা । তারপর তিন নম্বর টানেলের ওপর পোস্টের কাচের কাউন্টারেও একই কথা লিখলাম । এভাবে জুলাই বিপ্লবে আমার নিজস্ব অংশগ্রহণ তথা প্রতিবাদী দেওয়াল লেখা শুরু হয়ে গেল। পরিবারের সদস্যরা অবশ্য দাবি রাখছিল তাদের সঙ্গে নিয়ে ওসব করে বিপদের সাথী না করতে। পরের সপ্তাহে আবার গিয়েছিলাম বিস্তৃত ফাঁকা রাস্তায় ড্রাইভে । লক্ষ করলাম কাচের ওপর লেখাটা মুছে ফেলা হয়েছে। বিষয়টা মনে ধরল– লেখাত বেশ কাজে লাগছে! সুযোগ বুঝে এয়ারপোর্ট রোড ইসিবি চত্বরে লিখলাম। ‘গণহত্যার ক্ষমা নাই সকল ঘাতকের কল্লা চাই’ আমার প্রিয় এবং সেরা লেখা। জুলাই মাসে স্বৈরাচারীর নির্বিচারে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদ করেছে অনেকেই কিন্তু কেউ “গণহত্যা” উল্লেখ করেছে কিনা জানি না। শেষের সপ্তাহে আমার এই প্রতিবাদী দেওয়াল লেখায় যোগ দেয় শোয়েব আমান আর ইমরান কাজল। বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে একজন লিখি আর অন্য দুইজন কভার দেয়। দুষ্টু কাজল একরাতে ভিডিও করে হোয়াটস অ্যাপে পাঠাল কিন্তু আমি সতর্কতা বা ভয়ে সেটা মুছে ফেলেছিলাম তখনই- লিখার চেয়ে প্রমাণে ভয় বেশি! ওরা মিরপুর ডিওএইচএস-এর সামনের রাস্তায় লিখল ‘ছাত্র সৈনিক ভাই ভাই– খুনিদের রক্ষা নাই।’ দেওয়াল লিখনের বিশেষ রাত ছিল ৩ আগস্ট ’২৪। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান নাসির স্যারের বাসা থেকে মিটিং শেষে ওদের দুজনকে নামাতে কালশি মোড়ে গেলাম। রাত সাড়ে এগারোটায় মাথায় খেয়াল ভর করল লিখতে হবে। দোকানপাট বন্ধ থাকায় স্প্রে পেইন্ট খুঁজে পেতে বেশ অসুবিধা হলো। অনেক জায়গা ঘুরে চারটা পেইন্ট সংগ্রহ করা গেল। সেদিন আমরা ঠিক করলাম বাসে লিখব যেন আমাদের দ্রোহের ভাষা বাসের গতিপথে ছড়িয়ে পড়ে এবং বেশি মানুষ আমাদের সংক্ষুব্ধ বক্তব্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে। বাসে বা দেওয়াল লেখায় বড় প্রাপ্তি হলো আরেকজন সংক্ষুব্ধ বা অনুরণিত মানুষের কাছে দ্রোহ সহজেই সংক্রমিত হয়। সে ভাবতে থাকে– আরে, আমি তো দেখছি একা না আমার মতো আরও আছে বিক্ষুব্ধজন।
১৯ জুলাইয়ের পর মিরপুর ডিওএইচএস-এর ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল আশেপাশে। ইসিবি চত্বর এলাকা অন্যতম প্রতিরোধ পয়েন্ট হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে । সেনানিবাসে প্রবেশে এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায় । ফ্যাসিস্ট ইন্টারনেট বন্দ করে দেয়। কর্নেল হক স্যার আবার জরুরি সভার আহ্বান করেন ২৩ তারিখ বিকালে। সবাই আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সেদিনের উপস্থিতি আগের চেয়ে বেশি- নতুন দেখেছি কর্নেল দিদার, মেজর মিজান (১১), মেজর ইমরান (১১) এবং মেজর জাবের স্যারকে। লে. কর্নেল নাজিম স্যার যথারীতি খালি হাতে আসেন না– ওই সন্ধ্যাতেও শিঙ্গাড়া মিষ্টি জোগাড় করে এনেছিলেন। সবাই সম্মত হন যে আর নীরব থাকা যায় না অবসরপ্রাপ্তদের কমিউনিটির পক্ষ থেকে একটা বিবৃতি বা বার্তা পৌঁছাতে হবে জাতিকে। দুইটা কথা স্পস্ট করে বলতে হবে যে ছাত্রদের ন্যায্য আন্দলনের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং স্বৈরাচারের খুনসহ সকল দমন নিপীড়নের প্রতি তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন। তবে মতপার্থক্যও এগুতে থাকে সমানতালে- রাত এগিয়ে যায়। সারা দেশে কারফিউ তথা সান্ধ্য আইনের ঘোষণা আসে আমরা মিটিং-এ থাকতে থাকতে। জহুর স্যারও আসেন বিবৃতি পাঠের জন্য। হক স্যার দুইবার বিবৃতি ট্রায়াল দিলেও মতানৈক্যে না পৌঁছানর কারণে রাত সাড়ে ১১টায় আমরা মিটিং ছেড়ে যাই । কথা ছিল সে রাতে আমাদের স্পষ্ট বিবৃতি গণমাধ্যমে পৌঁছাবে! আমি, আয়ুব স্যার, মিজান স্যার এবং ইমরান স্যার ইসিবি চত্বরে এসে ব্যারিকেডের সামনে পড়ি। দূর থেকে শঙ্কা হচ্ছিল নিরাপত্তা বাহিনীর পোস্ট ভেবে। আলোচনা করছিলাম কি বলা উচিত? কাছে এসে দেখলাম ব্যারিকেড ছাত্রদের, ছোট থেকে বড় বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা– হাতে লাঠি। রাস্তায় বিশাল লেখা চোখে পড়ল- তুমি কে আমি কে? রাজাকার, রাজাকার। আমরা তাদের প্রতি সমর্থন এবং উৎসাহ ব্যক্ত করায় সানন্দে তারা ছেড়ে দিল। আমরা খুবই অবাক হলাম সেনানিবাসের এত কাছে কারফিউ-এর বিপরীতে মাঝরাতে ছাত্রদের শক্তিশালী অবস্থান দেখে ।
১৯ জুলাই ব্রিগেডিয়ার জহুর স্যারকে দেখা গেল সুমন ভাই ফ্যান ক্লাব পেজ থেকে ছাত্রদের সঙ্গে রাজপথে লাইভ করতে। ৩০ তারিখ লে. ফিরোজ ইফতেখার মার্চ টু ডেমক্রেসিতে যোগ দিতে কোর্টে গেল। বিভিন্ন মিডিয়ায় সেটা ফলাও হলো আর আমরা উৎসাহ পেলাম হুইসেল ব্লোয়ারকে দেখে। পহেলা জুলাই প্রেস ক্লাবের কর্মসূচিতে যোগ দেন ব্রিগেডিয়ার হাসান নাসির, কর্নেল হক, কর্নেল ফেরদৌস, ক্যাপ্টেন গনি আজম, মেজর শোয়েব এবং লে. ইমরান কাজল। বহুজাতিক কোম্পানির বাস্তবতার কারণে আমি অনুপস্থিত থাকি। ২ জুলাই ছিল শুক্রবার আমি পরিবারসহ সকালে বের হয়েছিলাম কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিন্যুতে একটা প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য। বনানী ডিওএইচএস হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে পোস্ট করা ব্যানারটা খুব আকর্ষণ করেছিল আমাকে– লেখা ছিল “তুমি সব ফুল ছিঁড়ে ফেলতে পার, বসন্ত আসবেই ঠেকাতে পারবে না …”।
টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল আমি কাঁচাবাজারের কাছে গাড়ি রেখে যোগ দিলাম স্বল্প মানুষের জমায়েতে, ছোট মেয়ের দোয়া ছিল সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যে পথচারীদের অংশগ্রহণে শ দুয়েক মাথা দাঁড়িয়ে গেল। হক স্যারের ফোন আসল বেলা ১১টায়- নামাজের পর পর বাসায় ডাকলেন। তিনি আর দেরি করতে চান না; সশস্ত্র বাহিনীর অবসরিদের পক্ষ থেকে বড় করে সবাইকে আহ্বান করতে চান স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। আমাকে বললেন একটা ব্যানার লাগবে যেহেতু ভিডিওবার্তা। শুক্রবারে প্রিন্টিং হাউজ বন্ধ তার উপর মিরপুর-১০ এলাকায় সংঘর্ষ চলছিল। আন্দোলন আত্মহুতির মাঝেই আমাদের ‘অবশ্যই উপস্থিতি’ ধরনের একটা বিয়ের আমন্ত্রণ ছিল মিরপুর-১১ নম্বরে। অনলাইনে ব্যাকড্রপের ড্রাফট আর কারেকশন দেওয়া-নেওয়া শেষে হক স্যার অনুমোদন দিলেন। আমি চাহিদামতো জুমার নামাজের মধ্যে প্রিন্ট করার ব্যবস্থা করলাম। বনানী ডিওএইচএস মসজিদে নামাজ শেষে দ্রুত বাসায় ফিরছি । পরিচিত সিনিয়র পিছ থেকে জানতে চাইলেন “কিছু কি হবে হায়দার”? আমি বলতে পেরেছিলাম “আল্লাহ চাইলে সব হবে স্যার”। উনি বলছিলেন “কিছু না হলে থাকতে পারবা তো এখানে?’’ আমার আর কোনো উত্তর দেওয়ার ছিল না। কারণ শেষের দশ-বারো বছর যেভাবে গিয়েছে তাতে আর ভয়ের কি-বা বাকি? পরিবার নিয়ে আল্লাহর নামে বের হলাম, ব্যানার সংগ্রহ করে অলিগলি ঘুরে মিরপুর দশের গোলচক্কর এড়িয়ে বিয়ের ভেন্যুতে পৌঁছলাম। সবাই গাড়ি থেকে নামার পর পার্ক করার কথা বলে ছুটলাম মিরপুর ডিওএইচএস-এর সেই বিখ্যাত ৯৫৭ বাসার দিকে। ঘরভর্তি সহযোদ্ধারা স্যারের চিলেকোঠায় অপেক্ষা করছে। আপ্লুত হলাম অনেকের মাঝে কোর্স মেট কর্নেল জাকারিয়াকে পেয়ে! হক স্যার নিজেই অনেক মানুষকে সেদিন হাজির করেছিলেন, একজন অনারারি ক্যাপ্টেন সাহেবও ছিলেন! যাই হোক ১৪ মিনিটের দি হক ভয়েস স্টাইলে জ্বালাময়ী বক্তব্য রেকর্ড হয়ে গেল প্রচারের জন্য। অনেক ‘যদি-কিন্তু’ মাড়িয়ে বানাতে পারা সেই ব্যানারটা ছাড়াও আমার সূচনা বক্তব্য ইতিহাসে জায়গা করে নিল । আমাদের রেকর্ডিং শেষ হতেই খবর এলো নিচে মিছিল হচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে, সামনে কিশোর তরুণরা থাকলেও মিছিলের লেজ দেখা যাচ্ছে না। সব বয়সিদের উপস্থিতি আছে- উন্নত বিশ্বে পরিবারের সবার উপস্থিতিতে পদযাত্রা যেমন হয় । একজন মা দুজন কিশোর ছেলে নিয়ে এসেছে, গেমস ড্রেস পরা অফিসার মেয়ের সঙ্গে স্লোগান দিচ্ছে, হাঁটতে থাকা সিনিয়র জেনারেল দ্রোহে পূর্ণ! দুই নম্বর অ্যাভিন্যুর গোরায় কমিউনিটি হলের সামনে হাজার দুয়েক সংক্ষুব্ধ মানুষ দাঁড়িয়ে শুনল হক স্যারসহ আরও দুজন সিনিয়রের বক্তব্য। সেদিন আর বিয়েতে যাওয়া হলো না– পরিবার নিজ দায়িত্বে ডিওএইচএস এসেছিল।
সংরক্ষিত সামরিক এলাকায় এমন ঘটনা আর কোথাও কখনও কি হয়েছে? জুলাই বিপ্লবের সাঈদ-মুগ্ধদের হত আত্মা সেটাই করাল। মিরপুর ডিওএইচএস জুলাই আন্দোলনে এক অনন্য অসাধারণ কীর্তি স্থাপন করল। পরদিন সকাল থেকে টহল বাড়ল, মাইকিং চলল মিটিং মিছিল না করার জন্য। কিন্তু ৩ আগস্ট বিকালে আগের দিনের চেয়েও তিনগুণ বড় হলো প্রতিবাদী মিছিল। ৪ তারিখেও বড় প্রতিবাদী যাত্রা হয় মিরপুর ডিওএইচএস-এ। আর ৫ আগস্ট সকালে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো মিরপুর ডিওএইচএসবাসী অংশ নেয় গণভবন যাত্রায়। ২ তারিখ মিছিলের সময় প্রিয় একজন অনুজ জানায় তারা সমসাময়িক কোর্সের দশ-বারোজন সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রয়োজনে অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ-যুবলীগের আক্রমণ প্রতিহত করে সন্তানদের বাঁচাতে তারা ব্যক্তিগত অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় অবস্থান নেবে।
অকাতরে ছাত্র-জনতার আত্মহুতিতে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে আগায়। দেশের মানুষ সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। ব্রিগেডিয়ার হাসান নাসির স্যারের বাসায় সিদ্ধান্ত হয় আমরা শহীদ মিনারে ছাত্র সমাবেশে অংশ নেব। আমি কর্নেল জাকারিয়া এবং কোর্সমেট আনিস আমার বাসা থেকে রওনা হই দুপুরের খাবার খেয়ে। কাটাবন প্লানিং একাডেমিতে গাড়ি রেখে এগিয়ে যাই শহীদ মিনার। সেদিন আরো ছিলেন ব্রিগেডিয়ার হাসান নাসির, কর্নেল হক, লে. কর্নেল হাসিনুর রহমান, লে. কর্নেল ফেরদৌস আজিজ , ব্রিগেডিয়ার শামস (২১), লে. কর্নেল সিদ্দিক, মেজর হাসান, ক্যাপ্টেন গনি আজম, মেজর মইনুল, মেজর শোয়েব আমান,ক্যাপ্টেন শামস ও লে. ইমরান কাজল। বৃষ্টি হচ্ছিল টিপটিপ করে আর তার মাঝেই শ্লোগানে শ্লোগানে আছড়ে পড়ছিল ক্ষোভ-দ্রোহ । আমাদের উপস্থিতি ছাত্র-জনতাকে উজ্জীবিত করছিল। কর্নেল হক স্যার স্বভাবসুলভ ভয়েজ ছড়িয়ে জানাচ্ছিলেন মূল বেদি থেকে নিচ পর্যন্ত যেখানেই মাইক্রোফোন এগিয়ে আসছিল। কিন্তু সবচেয়ে কার্যকর কাজটা করেছিল যমুনা টেলিভিশনের সম্প্রচার । প্রচার হওয়া আমাদের ছয়জনের বক্তব্যে দেশবাসী পরিষষ্কারভাবে জেনে গিয়েছিল আবসরি সেনা অফিসারেরা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্ম। কর্নেল জাকারিয়া আমার পাশে দাঁড়িয়ে যমুনা টেলিভিশনের মাইক্রোফোনে যে বক্তব্য দিয়েছিল সেটাই সম্ভবত জুলাই আন্দোলনের সবচেয়ে সাহসী উচ্চারণ। আমরা সাড়ে ৫টার দিকে শহীদ মিনার থেকে ফিরছিলাম। শাহবাগ পৌঁছাতে পৌঁছাতে খবর আসে ছাত্রদের নয় দফা চূড়ান্ত এক দফায় এসে ঠেকেছে– ফ্যাসিস্টকে পদত্যাগ করতেই হবে ।
৪ আগস্ট একযোগে মিরপুর, মহাখালী ও বনানী ডিওএইচএস-এ প্রতিবাদী শোভাযাত্রা হয় অধিবাসীদের ব্যাপক উপস্থিতিতে। বিকালে রাওয়াতে সিনিয়র অবসরিদের প্রতিবাদী সংবাদ সম্মেলন মিডিয়ায় প্রচার হলে বড় এবং গ্রহণযোগ্য (সামরিক অবসরিদের) সমর্থন জুটে যায়। কর্মসূচি আসে ৫ আগস্ট সকালে রাওয়ার সামনে সমাবেশের। সকালে অগ্রজ এবং অনুজ দিয়ে প্রায় দুশ’ আফিসার এবং প্রায় সব মিডিয়ার লেন্স তাক হয়ে থাকে সেই সমাবেশের দিকে। ঘোরের মধ্যে একটা দিন কাটে ঘটনায় ঘটনায় (আবার আলাদা করে লিখতে হবে সে দিনকে)। ক্যামেরার লেন্স লাইভে আমরা চিৎকার করতে করতে মিছিল নিয়ে জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত পৌঁছাই । চাকরিরত অনুজেরা একরকম কাকুতি-মিনতি করে মিছিল ফিরিয়ে দেয়। জেনারেল ফজলে এলাহি আকবর আর ব্রিগেডিয়ার সাইদুর রহমান স্যার কর্তব্যরত সেনা ও বিমানবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তাদের সঙ্গে করমর্দন করে তাদের সেই আবেদন রাখেন। আমি আমার ব্যাগ লোড করে নেই স্প্রে পেইন্ট কন্টেনারে। মহাখালী থেকে জাহাঙ্গীর গেট মন ভরে আমার দেওয়াল লেখা চালাই গণহত্যা ছাড়াও STEP DOWN HASINA যুক্ত হয় । সকালটা কিছু দোটানাতে কাটে কি হবে কি হতে যাচ্ছে– আবার কি হেরে গিয়ে হতাশায় তলিয়ে যাব! তারপর ১২টার পর থেকে উজ্জীবিত হতে থাকি। খবর আসতে শুরু করে এয়ারপোর্টের কাছে জনস্রোত ধেয়ে আসছে। সেই ঢেউ বেলা ১টার পর মহাখালী এসে যায় । সুনামির ঢেউয়ে ঢেউয়ে কোর্সমেট মেজর শামসুজোহা আর তার ছেলের সঙ্গে কারওরানবাজার ঘুরে গণভবন পৌঁছাতে ৪টা বেজে যায়। অনেক আগেই বিদায় হয়েছে গুম খুনের সেবাদাসী। সবাই যখন বিজয়ে উচ্ছ্বসিত তখন হাসান নাসির স্যার এবং হাসিন স্যার খেয়াল করেন গুম হওয়া অফিসারদের পরিণতির বিষয়ে । তারা সন্ধ্যায় লাইভ করে অবস্থান নেন কচুক্ষেতে, সাথে থাকেন ক্যাপ্টেন মারুফ কামাল স্যার, ফেরদৌস আজিজ স্যার, শোয়েব, কাজল, সাব্বিররা ।
ক্যালেন্ডারের ৫ আগস্ট ২৪ পরিণত হয় ৩৬ জুলাইতে ২৪। অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে আন্দোলন বিপ্লবের রূপ নিল সেই বিপ্লব কি ছুঁতে পারল বাংলাদেশকে?
লেখক :
মেজর (অব) মোঃ জামাল হায়দার
ফ্রি রেঞ্জ ন্যাশনালিস্ট
হার্ড কোর বাংলাদেশি



