
প্রিন্ট: ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০২ পিএম
কাদের জন্য জীবন দিচ্ছে মানুষ

গোলাম মর্তুজা অন্তু
প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৫, ১২:৪২ এএম

আপনার লাশ পড়লে কেউ দিল্লীতে বসে কেউ কাঁদবে এরকম কিছু ভাবছেন? না ভাই, লন্ডন, প্যারিসেও কেউ কাঁদবে না। শুধু আপনার পরিবারটাই ভুগবে। আপনার মা-বাবা হয়তো ভেবেছিল তাদের শেষ বয়সের অবলম্বন আপনি। আর কিছুদিন পর হয়তো আপনার হাত না ধরলে যেই বাবা হাঁটতেই পারবেন না, সেই বাবা আপনার লাশটা কাঁধে নিয়ে হাঁটবে কী করে কখনো ভেবেছেন? আপনার স্ত্রী আর সন্তান আছে? আপনার সন্তান আজীবন অন্য শিশুদের দিকে তাকিয়ে দেখবে অন্যদের বাবা আছে, তার নেই। সন্তানের সেই অসহায় শূন্যদৃষ্টি বেঁচে থাকা আপনি কখনো সহ্য করতে পারবেন না।
হাসপাতাল- মর্গ আমাদের নিয়মিত কর্মক্ষেত্র। প্রায়ই দেখতে হয়- কোন তরুণী স্বামী হারিয়ে চীৎকার করে কাঁদছেন। বৃদ্ধ বাবা মর্গের শেডের লম্বা বেঞ্চে বসে সুরতহালের কপিতে স্বাক্ষর দিচ্ছেন। সবাই কেন কাঁদছে, না চাইতেই চকলেট-জুস দিচ্ছে এসব বুঝতে না পেরে ফ্যালফেল করে তাকিয়ে থাকা কোন শিশু। এসব নিয়ে গণমাধ্যমে আমরা কান্নাকাটির যে গল্পটা ফাঁদি তাকে বলে ‘হিউম্যান স্টোরি’। আগে দুর্ঘটনা বা অন্য কোন ঘটনা ঘটলেই ওপর থেকে অর্ডার আসতো, ‘মেইন একটা, সাথে একটা হিউম্যান।’ হিউম্যান স্টোরির খুব কদর ছিল তখন, এখন সেটাও কমে গেছে। এখন মরে যাওয়া ছাত্রলীগ নিয়ে হিউম্যান স্টোরি করলে একদল বলবেন, ‘১৫ বছর কই ছিলেন!’ আবার বিগত বছরগুলোতে গুম, গুপ্তহত্যা, গায়েবি মামলার ভিকটিমদের নিয়ে হিউম্যান করতে গিয়ে রীতিমতো শাসকগোষ্ঠীর পাঙ্গা খেতে হয়েছে, কথা শুনতে হয়েছে। যার ফলাফল হচ্ছে দেশে এখন সব ইনহিউম্যান গল্পের ছড়াছড়ি। আর আমাদের অডিয়েন্স এখন এতো উত্তেজনাপ্রবণ যে সব জায়গাতেই ধামাকা, ভায়োলেন্স উত্তেজনা চাই। নিউজের নীচে কমেন্ট পড়া যায় না। কোন সমালোচনা নেই, ঢালাও অনুমাণ আর গালি।
আপনি এখনো বুঝছেন না, আপনাকে উত্তেজিত করে মাঠে নিতে পারলেই তাদের লাভ। আপনার লাশ পড়লে লাভের ওপর লাভ। এজন্য জনপ্রিয় সব মিডিয়া কন্টেন্টেই ‘জ্বলে ওঠার’ সুড়সুড়ি। কোন এক মহাজ্ঞানী বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষকে ** মারা দেওয়া খুব সহজ, কিন্তু তিনি যে ** মারা খাচ্ছেন সেটা তাকে বোঝানো খুবই কঠিণ।
এইতো কয়েকবছর আগের কথা। নরেন্দ্র মোদীর আগমন নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্র, বেশ কয়েকজন মাদ্রাসা ছাত্র গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। এরকম এক দুপুরে খবর এলো সেই ইসলামিস্ট দলেরই বিরাট নেতাকে এক রিসোর্টে আটকে রাখা হয়েছে, সঙ্গে এক নারী। তাদের আটকে মব করছে স্থানীয় সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা। মনে সন্দেহ নিয়ে পরিচিত এক কর্মকর্তাকে ফোন দিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই পাখি কোত্থেকে উড়ায় আনলেন।’ রসিক ভদ্রলোক বললেন, ‘পাখি নিজেই আইছে, অহন ভাজা হবে।’ আরও কিছু কথার পর সেই কর্মকর্তা যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ হচ্ছে- এই দেশে জীবনের কোন দাম নাই। যে দলের ছেলেরা একদিন আগেই গুলি খেয়ে মরেছে, সেই দলের নেতা অভিসারের বাসনাটা এড়াতে পারলেন না। বাড়ির কুকুর-বিড়ালের মৃত্যুতেও তো দুইদিন মন খারাপ থাকে।
গোয়েন্দা লোকটার কথা খুব মনে ধরেছিল।
আমার কাছে বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে খারাপ দিক হচ্ছে এখানে সবচেয়ে উপেক্ষিত হচ্ছে জনগণ। আর আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে এদেশের সাধারণ মানুষের মান-মর্যাদা পোকামাকড়েরও নীচে নামিয়ে দিয়েছিল শাসক গোষ্ঠী। এখন হানাহানির বাজারে জীবনের দাম আরও কমেছে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, এই মুহূর্তে আপনার দলের কাছে জীবিত আপনার চেয়ে মৃত আপনার দাম বেশি। আপনার মরামুখ যে গতিতে ভাইরাল হবে, জীবিত আপনি এক জীবন চেষ্টা করেও হয়তো সেটা করতে পারবেন না।
নিজের জীবনের দামটা মেপে নেবেন ভাইয়ারা। আপনি-আপনারা হরে-দরে মরবেন আর আপনার নেতাটি দেশের বাইরে নিরাপদ কক্ষে বসে ডায়েরিতে দাগ কেটে গুণতে থাকবেন। দেশে কোন কর্মীকে হয়তো হোয়াটসঅ্যাপ করে জিজ্ঞেস করবেন ‘কয়টা পড়ল? আমাদের কয়টা আর ওদের কয়টা?’
রাজনীতিবিদদের কাছে যেন মানুষের জীবনের দাম থাকে সেই প্রত্যাশায়…