
প্রিন্ট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:০৬ এএম
সারা বিশ্বের হাজিরা এখন মক্কায়

সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মক্কা নগরী :
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ০৬:৩৭ পিএম

ছবি- যুগের চিন্তা

ছবি- যুগের চিন্তা
পবিত্র মক্কা নগরী ও আশপাশ এলাকা লাখো মুসুল্লির পদচারনা ও লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বা্ইক ধ্বনিতে মহান আল্লাহ তায়ালা প্রতি অনুগত, বিশ্বাস ও একমাত্র তারই রাজত্বের ঘোষণার এক অপূর্ব মিলনমেলা ও মুসলিম জাহানের ধর্মীয় অনুভূতির সর্বশ্রেষ্ট প্রকাশ।
কারণ হজ্জ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম রুকন। হজ্ব একটি ফরয ইবাদত। যা সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের উপর ফরয। তাই এর গুরুত্ব যেমন অপরিসীম তেমনি ফযীলতও সীমাহীন। এই পৃথিবীতে মুসলমান জাতির যত নেক আমল রয়েছে তন্মধ্যে হজ্জ শ্রেষ্ঠতম। রাসূল (সা) অন্য সকল আমলের উপর হজ্জের মর্যাদাকে পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্তের দূরত্বের সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পবিত্রতার সাথে হজ্জ পালনকারীকে গুনাহমুক্ত নবজাতকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কবুল হজ্জের পুরস্কার নিশ্চিত জান্নাত।
তাছাড়া, হজ্জের প্রতিটি কর্ম সম্পাদনের জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক পুরস্কার, ফযীলত ও মর্যাদা। হজ্জের ইবাদতের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মুসলিম জাহানের উন্মতরা একত্রিত হওয়ার এক বিশাল সুযোগ লাভ করে।
যদিও হজের মূল কাজ শুরু হয় জিলহজ মাসের ৮ তারিখ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত। এই পাঁচদিনই হাজিদের পবিত্র ও সর্তকতার সাথে কাজ করতে হয়। সাধারণত ৮ তারিখ পবিত্র মক্কা শরিফ থেকে হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে মিনায় গমনের মাধ্যমে হজের কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রচন্ড ভিড় ও সহজ করার জন্য জিলহজের ৭ তারিখ রাত থেকেই হজের ইহরাম বাঁধা ও মিনায় অবস্থান করানোর চেষ্টা চলে। কার্যত হজের কার্যক্রম শুরু হয় ৮ জিলহজ। ৭ তারিখ রাত থেকে মক্কার হারাম শরিফ বা বাসা/হোটেল থেকে হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হন। হাজিগণ সবাই ইহরামের কাপড়, হালকা শুকনো খাবার, গামছাসহ আরও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র একটি ছোট্ট ব্যাগে নিয়ে নিবেন। ৮ জিলহজ জোহর থেকে ৯ জিলহজ ফজর পর্যন্ত ৫ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করা মোস্তাহাব এবং
সেখানে অবস্থান করা সুন্নাত। তবে এদিন মিনায় কোনো নির্দিষ্ট কাজ থাকে না। মিনায় গিয়ে হাজি সাহেবান আল্লাহ তায়ালা সন্তোষ্টিলাভ ও হজ কবুলের জন্য ইবাদত বন্দেগিতে মগ্ন থাকবে। মিনায় অবস্থান করাও একটি বড় ইবাদত। পরের দিন ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করবেন হাজিরা। জিলহজের ৯ তারিখে ঐতিহাসিক আরাফার ময়দানে হজের মূল কাজ অনুষ্ঠিত হব। জিলহজের ৯ তারিখে দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার ময়দানে অবস্থান করতে হবে। এ অবস্থানকরাকে আরবি ভাষায় উকুফে আরাফা বলা হয়। উকুফে আরাফাকেই হজ বলা হয়। উকুফে আরাফা করতে না পারলে হজ হয় না। ৯ জিলহজ ফজরের পর সম্ভব হলে মিনায় গোসল করা উত্তম। তা না হলে ওজু করে সকাল সকাল আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হবে। কিন্তু বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৮ তারিখ রাত থেকেই হাজিদের আরাফায় নিতে শুরু করে। সুতরাং আরাফার ময়দানে গিয়ে গোসল করা উত্তম। ৯ জিলহজ জোহরের আগেই হজের অন্যতম রোকন পালনে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হতে হয় এবং সন্ধ্যায়
প্রথম যে জামরাটি দেখবেন এটি ছোট জামরা বা ছোট শয়তান। তার পরেরটি মধ্যম জামরা বা মাধ্যম শয়তান। তার পরেরটি বড় জামরা বা বড় শয়তান। ১০ জিলহজ ছোট ও মধ্যম জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা হয় না। শুধুমাত্র সর্বশেষ জামরা তথা বড় শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করবে। বড় জামরায় ৭টি কংকর নিক্ষেপ করবে। কংকরগুলো নির্দিষ্ট বৃত্তের ভেতরে ফেলতে হবে। কোনোভাবেই যেন বৃত্তের বাইরে না পড়ে। যে কংকর বৃত্তের বাইরে পড়বে তার পরিবর্তে আরেকটি কংকর বৃত্তের ভেতরে ফেলতে হবে।
হজের কোরবানি করা : জামরায় কংকর নিক্ষেপের পর দ্বিতীয় কাজ হলো হজের কোরবানি করা। এই কোরবানিকে দমে শোকর বা কৃতজ্ঞতার কোরবানি বলা হয়। হজ আদায়ের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই কোরবানি করা হয় বিধায় তাকে দমে শোকর বলা হয়। এটি সম্পদের কারণে ওয়াজিব হওয়া কোরবানি থেকে আলাদা। কারো সম্পদ থাকলে দমে শোকরের পাশাপাশি আরো একটি কোরবানি দিতে হবে।
মাথা মুণ্ডন করা : এ দিনের তৃতীয় কাজ মাথা মুণ্ডন করা। তবে পশু কোরবানির আগে মাথা মুণ্ডাবে না। পশু কোরবানির ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর মাথা মুণ্ডাবে। এ ব্যাপারে অনেকের ত্রুটি হয়ে যায়। তাই সতর্ক থাকতে হবে। মাথা মুণ্ডনের মাধ্যমে ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাবে এবং গোসল করে সাধারণ পোশাক পরিধান করে নিবে।
তাওয়াফে জিয়ারত : এদিনের আরেকটি কাজ কাবা শরিফের তাওয়াফ করা ও সায়ি করা। এটিকে তাওয়াফে জিয়ারত বলা হয়। এই তাওয়াফটি হচ্ছে ফরজ। এটি না করলে হজ বাতিল হয়ে যাবে। তবে তাওয়াফটি ১০ জিলহজ তারিখেই করতে হবে এমন নয়। ১০ তারিখে সম্ভব না হলে ১১ বা ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত যেকোনো সময়ে করা যাবে। তবে ১০ তারিখে করা উত্তম। ১০ তারিখ তাওয়াফে জিয়ারত সম্পন্ন করে মিনায় চলে যাবে এবং মিনায় রাত যাপন করবে। ১১ ও ১২ তারিখে মিনায় অবস্থান করে কংকর নিক্ষেপ করতে হবে। ১১ ও ১২ জিলহজের কাজ হলো মিনায় অবস্থান করা এবং প্রতিদিন তিনটি জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা। তাওয়াফে জিয়ারত আদায় করা। করতে না পারলে ১২ জিলহজ সুর্যাস্তের আগে পাথর মারার কাজ অবশ্যই সম্পাদন করতে হবে। ১২ তারিখের পর হাজি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে। তবে, ১০ তারিখ পাথর নিক্ষেপ করা, জবে (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) মাথা মণ্ডানো এই কাজগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরী।
হজ করতে এসেছেন ঢাকার মগবাজার থেকে ফজলে মোহাম্মদ শাহনওয়াজ। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন,বোঝার বয়স থেকে স্বপ্ন ছিল হবে কবে কাবা শরীফ দেখবো। মহান রাব্বুল আলামিন সে আশা পূবণ করেছেন বলে তিনি কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন জীবনের শেষ বেলায় স্ত্রীর আশাও পূরণ হয়েছে। আল্লাহ তাআয়ালা হজও কবুল করুন। তিনি বলেন, হজের খরচ অনেক বেশি হওয়ায় ইচ্ছে থাকা সত্বেও বন্ধু- বান্ধব,আত্মীয়- স্বজন অনেকেই শেষ সময়ে আসতে পারেননি।
হজ করতে আসা মোহাদ্মাদিছ ওলানা সুয়াইব আবদুর রউফ বলেন, ফি বছরই আমাকে হজ্বে আসতে হয়। গত কয়েক বছরে কাবা শরীফ, মিনা, মুজতালিফা, জামারতসহ মক্কা নগরীকে আরও আধুনিক শৈল্যস্থাপত্যে ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে। ফলে হাজিদের হজ্ব পালন অনেক সহজতর হয়েছে। বিশেষ করে হারাম শরীফের পরিধিবৃদ্ধি করে হাজিদের নামাজ আদায়ের কাজটি অধিকতর সহজ করা হয়েছে।
মাওলানা শরীফ নূরানীর ভাষ্য, প্রতি বছরই উন্নয়ন ও পরিবর্তন হচ্ছে মক্কা নগরীর। সেই সঙ্গে কঠোর নিয়ম কানুন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আইডি ছাড়া কেউ বের হলে আকস্মিক পুলিশ পরিচয় যাচাই করছে। এবার জামারতের ব্যাপক উন্নয়নের কারণে শযতানকে পাথর নিক্ষেপ করার কাজটি সহজতর হবে।
এখানে অবস্থান করলেই দুনিয়া ও আখিরাত সম্পর্কে হৃদয়বৃত্তিয় আবেগ ও সংশোধনের মাধ্যমে মানুষ ইহলৌকিকতা বাদ দিয়ে পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের মাধ্যমে আখেরাতকে অতিক্রম করতে পারবে। তাই হজ্ব করা সকল বিত্তমান মুসলমানের জন্য ফরজ।।
সৌদি কর্তৃপক্ষ জানান,২০২৪ সালে মোট ১৮ লক্ষ ৩৩ হাজার ১৬৪ জন হজ পালন করেছেন। এরমধ্যে সারা বিশ্ব থেকে ১৬ লক্ষ ১১ হাজান ৩১০ জন। এরমধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৭৫ হাজার ৫৭৯ জন। এবার সারা বিশ্ব থেকে কতজন হাজব এসেছেন তা জানা যায়নি।
তবে, বাংলাদেশ থেকে ৮৫১৬৪ হাজি হজ্ব পালন করতে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সৌদিতে এসেছেন।
গত বছরের তুলনায় এবার লাখ দুয়েক হাজি কম হবে বলে হজ এজেন্সি ও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।