
প্রিন্ট: ২৩ জুন ২০২৫, ১০:৫০ পিএম
আ.লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা মৌলিক স্বাধীনতার জন্য হুমকি: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫, ০২:০৯ পিএম

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক আইন ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ দেশের মৌলিক স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলছে বলে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানিয়েছে, সরকার গঠনের পর কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নিলেও সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
গতকাল বুধবার প্রকাশিত বিবৃতিতে এইচআরডব্লিউ জানায়, ১২ মে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের কঠোর সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওপর ‘অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা’ জারি করে। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় দলটির পক্ষে সভা-সমাবেশ, প্রচার, প্রকাশনা ও অনলাইন কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, “শেখ হাসিনার সরকার বিরোধীদের দমনে যেভাবে আইনের অপব্যবহার করেছে, অন্তর্বর্তী সরকার যদি একই কৌশলে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের দমন করে, তবে তা গুরুতর মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হবে।”
তিনি আরও বলেন, “গুমসংক্রান্ত যে আইন প্রস্তাব করা হয়েছে, তা হাসিনা সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া শত শত গুমের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের জন্য ন্যায়বিচার আনতে ব্যর্থ হবে।”
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট ব্যাপক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এই আন্দোলনে প্রাণ হারান প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন। এরপর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শপথ নেয় এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেয়।
এইচআরডব্লিউ বলেছে, আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে যতদিন না দলটির নেতারা তাদের ১৫ বছরের শাসনামলে সংঘটিত অপব্যবহারের জন্য বিচারের মুখোমুখি হন। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে।
এই নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর একটি সাম্প্রতিক সংশোধনীর পর জারি করা হয়। সংশোধিত এই আইনে ট্রাইব্যুনালকে রাজনৈতিক সংগঠন বিচারের আওতায় এনে বিলুপ্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। নতুন বিধানে ‘সংগঠন’ শব্দটি যেকোনো রাজনৈতিক দল, সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী বা তাদের সমর্থনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাপকভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
এইচআরডব্লিউর বিবৃতিতে বলা হয়, “হাসিনা সরকারের আমলে সংঘটিত অপরাধের জন্য যথাযথ বিচার প্রয়োজন। তবে সমগ্র একটি রাজনৈতিক দল ও তার সমর্থকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা মৌলিক মানবাধিকার, বিশেষত বাক্স্বাধীনতা ও সংগঠনের স্বাধীনতার ওপর এক চরম আঘাত।”
ইতোমধ্যে অভিনেতা, গায়ক, আইনজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীসহ বহু মানুষকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রসিকিউটররা এসব ব্যক্তিকে ‘ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের সমর্থক’ আখ্যায়িত করে এসব গ্রেপ্তারকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
অন্যদিকে, হাসিনা সরকারের আমলে সংগঠিত গুমের ঘটনা তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট একটি কমিশন গঠন করে। কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, তারা ১,৬৭৬টি গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে, যার মধ্যে প্রায় ২০০ জনের এখনও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে এসব গুমকে ‘পদ্ধতিগত নিধন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত গোপন আটককেন্দ্রে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
কমিশন তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছে। তবে প্রস্তাবিত গুমবিরোধী আইনে কমিশনের তথ্য-প্রমাণের ব্যবহার নিয়ে কোনো উল্লেখ নেই এবং সংগঠিত ও পদ্ধতিগত গুমের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতো বিতর্কিত ও সম্পদ-স্বল্প সংস্থার আওতায় ফেলে রাখা হয়েছে।
এইচআরডব্লিউর মতে, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি হলেও মানবাধিকার রক্ষায় ভারসাম্য বজায় রাখা এবং আইনের অপব্যবহার না করাটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।