
প্রিন্ট: ২৪ জুন ২০২৫, ১২:৫২ এএম
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপড়েনে চাপে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ মে ২০২৫, ০২:১৬ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপড়েনের মধ্যেই পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত ও বাংলাদেশ, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও কূটনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব পদক্ষেপে গভীর উদ্বেগে পড়েছেন দুই দেশের ব্যবসায়ীরা।
গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ভারত থেকে স্থলপথে তুলার সুতা (ইয়ার্ন) আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে, যার পেছনে যুক্তি ছিল—স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ভারত হঠাৎ করে বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে দেয়। এই ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারতের বন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য পাঠাতো। ভারত এই সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে বন্দরে যানজটের কথা বললেও, বিশ্লেষকরা একে রাজনৈতিক চাপের অংশ হিসেবে দেখছেন।
রাজনৈতিক দিক থেকেও পরিস্থিতি জটিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বর্তমানে ভারতে নির্বাসিত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বে রয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সরকার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে তাকে ফেরত চেয়েছে। হাসিনা অভিযোগ অস্বীকার করলেও দিল্লি এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
ভারত এরই মধ্যে বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে, যা আরও উত্তেজনা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এটি সাধারণ অপরাধ বা রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত ঘটনা।
বাণিজ্যের দিক থেকে এই উত্তেজনা বড় ধাক্কা। বাংলাদেশের পোশাক খাত ভারতীয় সুতার ওপর নির্ভরশীল। ভারত ২০২৪ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১.৬ বিলিয়ন ডলারের সুতা রপ্তানি করেছিল, যার এক-তৃতীয়াংশ স্থলপথে এসেছিল। এখন সমুদ্র বা আকাশপথে আমদানিতে সময় ও খরচ বেড়ে গেছে। এমজিএইচ গ্রুপের প্রধান আনিস আহমেদ জানান, আগে যে পণ্য ৭ দিনে পৌঁছাত, এখন তা পৌঁছাতে ৮ সপ্তাহ লাগছে।
অন্যদিকে, ভারতীয় ভিসা নীতির কঠোরতার কারণে বাংলাদেশিদের ক্ষোভ বাড়ছে। প্রতিবছর যে ২০ লাখ বাংলাদেশি চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা ও ভ্রমণে ভারতে যেতেন, সাম্প্রতিক সময়ে সেই সংখ্যায় ৮০ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পেয়েছে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শ্যাম স্মরণ বলেন, “হাসিনাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার কোনও বাস্তব সম্ভাবনা নেই। আমরা জানি, তার ভাগ্যে কী ঘটতে পারে।” ভারতের পোশাক প্রস্তুতকারক সংগঠন ইতোমধ্যে বাংলাদেশি পোশাক আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার দাবি জানিয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (CPD) সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “বাংলাদেশে এখন ভারতকে দেওয়া ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধাগুলোর পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে।”
ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশি অবকাঠামোর ওপর নির্ভরতা থাকলেও, এখন পর্যন্ত ট্রানজিট সুবিধা প্রত্যাশামতো কাজে লাগেনি বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি ড. ইউনূসের চীন সফরের সময় তাঁর কিছু মন্তব্যও দিল্লিকে ক্ষুব্ধ করেছে। তিনি বলেন, “ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একমাত্র সমুদ্র অভিভাবক বাংলাদেশ, যা চীনের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের ক্ষেত্র হতে পারে।” এই মন্তব্য ভারতের শিলিগুড়ি করিডর ঘিরে কৌশলগত উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এছাড়া, বাংলাদেশে চীনের প্রস্তাবিত ১ বিলিয়ন ডলারের তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আগ্রহও ভারতকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে, যেহেতু প্রকল্পটি শিলিগুড়ি করিডরের কাছাকাছি অবস্থিত।
এই ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ দুই দেশের সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে, যার প্রভাব পড়ছে ব্যবসা, কূটনীতি ও সাধারণ মানুষের ওপর।