Logo
Logo
×

বিশেষ সংবাদ

বিড়ি লিটনের ডেরায় নিহত এমপি আনারের গাড়ি

Icon

স্টাফ রিপোরর্টার :

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৫, ০৯:০২ পিএম

বিড়ি লিটনের ডেরায়  নিহত এমপি আনারের গাড়ি

ছবি- সংগৃহীত

কোলকাতায় নিহত সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের শুল্কমুক্ত কোটায় আনা গাড়ি উদ্ধারের পর নতুন করে আলোচনায় ‘ক্লুলেস’ হত্যাকান্ডটি। সোমবার কুষ্টিয়ার একটি সিগারেট ফ্যাক্টরী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে আনারের গাড়ি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র আবদুস সবুর লিটনের ব্যবসায়ীক অংশীদার মুস্তাফিজুর রহমানের পার্কিং থেকে গাড়িটি উদ্ধার করা হয়।

লিটন বর্তমানে চট্টগ্রামের হালিশহর থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পদে রয়েছেন। এই লিটন ও মুস্তাফিজের বিরুদ্ধে চোরাচালনাসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এই গাড়ির সূত্র ধরে আনার হত্যার তদন্তে নতুন মোড় নিতে পারে।

সুত্রমতে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার দুইদিন পর ফ্লাইটে দুবাই চলে যান লিটন। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান, নকল সিগারেট, জাল ব্যান্ডরোলের ব্যবসায় লিটন কামিয়েছেন অন্তত ত্রিশ হাজার কোটি টাকা। লিটনের ডেরায় খুন হওয়া সংসদ সদস্যের গাড়ি পাওয়ার পর আনার হত্যায় নতুন করে চাউর হচ্ছে সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী নওফেলের নামও। কারণ আবদুস সবুর লিটনের উত্থানের পেছনের শক্তি ছিলো মহিবুল হাসান নওফেল।

গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, আনারের গাড়ি তার খুনের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে নতুন ক্লু। এই গাড়িটি এর আগে চট্টগ্রামে ছিলো। চট্টগ্রাম রুটে সোনা ও সিগারেট চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকতে পারেন আনোয়ারুল আজীম আনার।

সুত্রমতে, সংসদ সদস্য কোটায় গাড়িটি আমদানি করা হয়েছিলো। গাড়ি আমদানির অর্থ পরিশোধ করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের  সাবেক কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটন। লিটনের বিভিন্ন  বিড়ি কারখানার ব্যবসার অংশীদার হিসেবে সাবেক মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও রয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। তবে ‘তারা টবাকোর’ ৪০ শতাংশের মালিক কুষ্টিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান। জেনুইন লিপ কোম্পানি বলে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নামও এসেছে সামনে। সেই প্রতিষ্ঠানও লিটনের।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো ও তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো,জেনুইন লিপসহ কয়েকটি সিগারেট কারখানার মালিক আবদুস সবুর লিটন । এসব কারখানায় প্রস্তুতকৃত সিগারেটে নকল ব্যান্ডরোল লাগানো হত। ভ্যাট গোয়েন্দা একটি টিম তদন্ত করে এসবের সত্যতা পেয়েছিলেন কয়েকবছর আগেই। কিন্তু সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান নওফেলের প্রভাবের কারণে শেষমেষ লিটন ওরফে ‘বিড়ি লিটনের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি এনবিআর। সোমবার তার গাড়ি উদ্ধার নিয়ে স্থানীয়রা জানান, সোমবার সাফিনা টাওয়ারের গ্যারেজে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের গাড়ি রাখা আছে এমন খবরে ভিড় করে লোকজন। পরে ভবনের পার্কিং জোনে বিলাসবহুল গাড়িটি পেয়ে পুলিশে খবর দেন তারা।

ভবনটির কেয়ারটেকার আলমগীর হোসেন বলেন, “জেনুইন লিফ কোম্পানি নামে একটা সিগারেট কোম্পানি দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় বাসা ভাড়া নিয়েছে। সেখানে ফরেনাররা আসেন, থাকেন এবং খাওয়া-দাওয়া করেন। তারাই গাড়িটা রাখার ব্যবস্থা করেছেন। '

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ভৈরব উপজেলার শম্ভুপুরে তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো কোম্পানিতে যৌথ বাহিনী অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে ৫৩ হাজার অবৈধ রাজস্ব স্ট্যাম্প এবং নকল সন্দেহে ১৩ লাখ ১৯ হাজার ৮২০ শলাকা সিগারেট জব্দ করা হয়। পরে নকল পণ্য উৎপাদনের অভিযোগে তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো কোম্পানিকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিলো। আবদুস সবুর লিটনের কোম্পানিটি জাল ব্যান্ডরোলের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে এসেছে। বিভিন্ন সময় অভিযানে তারা টোবাকোর বিভিন্ন ফ্যাক্টরী থেকে বিপুল পরিমাণ সিগারেট ও ব্যান্ডরোল জব্দ করা হলেও দুবাই পালিয়ে যাওয়া লিটন সব সময়ই ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন ও মালিকানা পত্রে আনোয়ারুল আজীম আনারের নাম উল্লেখ রয়েছে। সাফিনা টাওয়ারের ফ্ল্যাট মালিক ও ভাড়াটিয়ার চুক্তিপত্র অনুযায়ী মেহেরপুর জেলার গাংনী পৌরসভার বাঁশবাড়িয়া দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা মুস্তাফিজুর রহমান ভবনের তিনটি ইউনিট ও তিনটি গাড়ির পার্কিং স্পেস ভাড়া নেন। গাড়িটি বর্তমানে মুস্তাফিজুর রহমানের পার্কিং স্পেসে রয়েছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ভাড়া নিয়েছেন তিনি। এমপি আনারের মেয়ে ডরিন মুঠোফোনে গাড়িটি তার বাবার বলে জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ নেতা আনার ছিলেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য। গতবছর ১১ মে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন।তার বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাস কলকাতায় জিডি করার পর দুই দেশে তদন্ত শুরু হয়। পরে জানা যায়, এমপি আনারকে কলকাতার এক বাড়িতে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ওই ঘটনায় কলকাতায় মামলা হয়। আনারের মেয়ে ডরিনও ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেন।

সংশ্লিষ্ট গাড়ি রপ্তানিকারকের সাথে ঘনিষ্ঠ সুত্র মতে, গেল বছরের অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামের পাঁচ তারাকা হোটেল রেডিশন ব্লু'র কার পার্কিং-এ গাড়িটি বুঝে নেন আবদুস সবুর লিটনের ম্যানেজার একেএম জিয়া ও প্রীতি আচার্য  নামের একজন নারী। টয়োটা ব্র্যান্ডের ল্যান্ডক্রজার প্রাডো মডেলের কালো রঙয়ের গাড়িটির নম্বর ‘ঢাকা মেট্রো-ঘ ১২-৬০৬০’। জিয়া দুবাই পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা  আবদুস সবুর লিটনের অবৈধ ব্যবসা দেখাশুনা করছেন।

অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কোরবানি ঈদের দুদিন আগে আবদুস সবুর লিটনের মানেজার একেএম জিয়া গিয়েছিলেন কুষ্টিয়ায়। তার মোবাইল লোকেশান ছিলো গাড়ি উদ্ধার হওয়া ভবনে। ৫ ই জুন সেখানে যান তিনি। ৬ই জুন কুষ্টিয়া থেকে চট্টগ্রামে ফিরেন তিনি।

আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, প্রীতি পরিচিত অধরা নামে। সে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সবুর লিটনের দ্বিতীয় স্ত্রী বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। সূত্রটি জানিয়েছে লিটনের ব্যক্তিগত  গাড়িটিও বর্তমানে প্রীতির হেফাজতে আছে। এমপি আনারের নামে আনা গাড়ি ডেলিভারির আগেই কোলকাতার একটি ভবনে আততায়ীদের হাতে খুন হন এমপি আনার। সূত্রটি জানিয়েছে, বিড়ি লিটনের সাথে চোরাচালান নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে খুন হতে পারেন আনার।

উদ্ধার হওয়া গাড়ির ড্রাইভার বেলাল জানান, বেলাল স্যার আর জাহিদ ( সিইও জেনুইন  লিপ) স্যার সব কিছু জানেন। তাদের হুকুমে গাড়ি স্ট্যার্ট দিয়েছি। এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। গাড়ি থেকে পুলিশ কাগজপত্র, লাইসেন্স ও স্টিকার উদ্ধার করেছে। সেখানে গাড়ির মালিকের নাম লেখা আছে। এই গাড়িটি আমি কখনো চালাইনি। '

এ বিষয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশাররফ হোসেন বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


অনুসন্ধানে জানা যায়, মুস্তাফিজুর রহমান কুষ্টিয়ার দশ মাইল এলাকায় অবস্থিত 'তারা টোবাকো' নামক একটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার। এই প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ শেয়ারের মালিক চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা  আবদুস সবুর লিটন।

গত বছরের ১৭ অক্টোবর হালিশহর আবাসিকের আল ফরিদ ভবনে লিটনের বাড়িতেও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিলো। অভিযানে  বাসাটি থেকে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার পিস সিগারেট স্ট্যাম্প, ১৪৮টি সাদা বড় রোল, ৪২৫টি সাদা ছোট রোল, ১২৬টি কালো বড় রোল ও ১ হাজার ৩৭টি কালো ছোট রোল জব্দ করা হয়েছিলো। সূত্রমতে, শুল্কমুক্ত গাড়িটি কিনে নিয়েছিলেন আবদুস সবুর লিটন। নিজের একটি প্রতিষ্ঠানের একাউন্ট থেকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে মুল্যও পরিশোধ করেছেন। কিন্তু এমপি আনার মারা যাওয়ার কারণে গাড়িটির রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। পরবর্তীতে গাড়িটি কুষ্টিয়ায় এমপি আনারের কোন এক আত্মীয়ের হেফাজতে দেন লিটনের ম্যানেজার একেএম জিয়া। গাড়ির বিষয়ে  জানতে জেনুইন লিপ কোম্পানির সিইও জাহেদ আনোয়ারকে কল করা হলে তিনি সাড়া দেননি। সাড়া দেননি আবদুস সবুর লিটনের ম্যানেজার একেএম জিয়াও। 

কে এই লিটন 

চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের রামপুরা এলাকার বাসিন্দা আবদুর সবুর লিটন। লিটনের প্রয়াত বাবা সেলিম ছিলেন আকিজ বিড়ি কারখানার একজন টেকনিশিয়ান। একসময় নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা থাকলেও দুবাই ও পুর্তগালে অন্তত বিশ হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন লিটন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান লিটন- কেরামত আলী নামের এক ব্যক্তির অনুগ্রহে একটি বিড়ি কোম্পানিতে কাজ নেন লিটন। পরে শ্রমিক সরবরাহ ও সিগারেটের ব্যান্ডরোল ব্যবসায় নামেন তিনি। শিক্ষা মন্ত্রী নওফেলকে ব্যবসায় ভেড়ানোর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি লিটনকে। পরবর্তী সময়ে তিনি নকল বিড়ি, সিগারেট ও ব্যান্ডরোল তৈরি, স্বর্ণ চোরাচালান, অস্ত্র ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এ সময় তাঁর সঙ্গে সখ্য হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হন কাউন্সিলর। পরে টাকার জোরে বাগিয়ে নেন প্যানেল মেয়রের পদও। এখন একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি একরের পর একর জায়গা, বাড়ি-বাগানবাড়ি, গাড়িসহ কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদের মালিক লিটন। তাঁর ছোট ভাই যুবলীগের রাজনীতিতে জড়িত আব্দুল মান্নান খোকনও নকল সিগারেট, স্বর্ণ চোরাচালানের মতো অবৈধ কারবারে জড়িত। সম্প্রতি দুবাইয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন খোকন।

Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন