
প্রিন্ট: ২৩ জুন ২০২৫, ০৩:৪৮ পিএম

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৫, ১০:০৫ এএম

ছবি : সংগৃহীত
জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) সম্প্রতি জানিয়েছে, উন্নত জীবন ও উচ্চশিক্ষার প্রত্যাশায় গত দেড় দশকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের দেশত্যাগের হার তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মূল লক্ষ্য এখন বিদেশে পাড়ি জমানো।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে গিয়ে হতাশ হচ্ছেন অধিকাংশ তরুণ, যা দেশত্যাগের প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আয়াজ বিন ফারুকের কথায়, “পাস করে হয় বিসিএস, না হয় ব্যাংক পরীক্ষা, আর তাও না হলে আইইএলটিএস দিয়ে বিদেশ—এই তিনটিই মূল বিকল্প।” কিন্তু বিসিএস পরীক্ষায় প্রতি বছর আবেদনকারীর তুলনায় পদের সংখ্যা থাকে অত্যন্ত কম। যেমন ৪৬তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি, অথচ শূন্য পদ মাত্র ৩ হাজার ১৪০টি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সফিউর রহমান বলেন, “বাংলাদেশে বিসিএস যেন সোনার হরিণ। তাই অনেকেই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে দেশ ছাড়ার দিকেই ঝুঁকছে।”
নারী শিক্ষার্থীরাও একই পথে হাঁটছেন। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ফাতেহা জাহান ইকু যুক্তরাজ্যে পড়তে গিয়ে জানান, দেশের কর্মক্ষেত্রে নারীদের সমানাধিকার না পাওয়া এবং সামাজিক অবস্থান যথাযথ না হওয়ায় অনেক নারী শিক্ষার্থী বিদেশকে নিরাপদ ও সম্মানজনক মনে করছেন।
ব্যানবেইসের হিসাবে, প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক সম্পন্ন করে, কিন্তু নেই তাদের জন্য পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ বা সুষ্ঠু পরিকল্পনা। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনের শিক্ষক মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, “চাকরির ঘাটতি এবং বিদেশফেরতদের দক্ষতা মূল্যায়নের অভাবে মেধা পাচার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়েছে।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবও দিচ্ছে একই বার্তা—দেশে ১২ শতাংশ বেকার স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী, যেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রাপ্তদের বেকারত্ব তুলনামূলক কম।
অন্যদিকে, যারা চাকরি করছেন তারাও সন্তুষ্ট নন। করপোরেট কর্মী ফয়সাল রিমন বলেন, “বাংলাদেশে অফিস সংস্কৃতি এখনও পুরনো ধাঁচের। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে শ্রম আইন মানা হয় না, বেতন ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও সচ্ছতা নেই।”
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ছাত্র শাফায়াত আল রাজি যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার পাশাপাশি আয় করে পরিবারকে সহায়তা করতে পারছেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এই সুযোগ একপ্রকার অকল্পনীয়।”
২০২৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গেছে ৫২ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থী। ২০০৮ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ হাজার ৮০৯। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই গত বছর গেছেন ১৭ হাজার, যা এক বছরে ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের ফেলো গবেষক নুসরাত জাহান চৌধুরী বলছেন, বিদেশফেরতরা দেশে যোগ দিলেও তাদের দক্ষতার সঠিক মূল্যায়ন হয় না। বরং প্রচলিত নিয়ম ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তাদের ভূমিকা সীমিত হয়ে পড়ে।
জার্মানভিত্তিক সংস্থা ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড করপোরেশনের মতে, এক সময় মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক পাঠানোতে আগ্রহ থাকলেও বর্তমানে শিক্ষিত শ্রেণি পশ্চিমা দেশে স্থায়ী হতে চাইছে। তাদের ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
এই পরিস্থিতিতে গবেষকরা বলছেন, রেমিট্যান্সনির্ভর অর্থনীতি নয়, বরং দক্ষতা ও মেধা ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার। বিদেশফেরতদের জন্য দেশে উপযুক্ত কর্মপরিবেশ এবং মূল্যায়নের সুযোগ তৈরি করলেই দেশপ্রেম ও মেধার সঠিক ব্যবহার সম্ভব হবে।