Logo
Logo
×

বিশেষ সংবাদ

এক স্বপ্নবাজ শহুরে কৃষকের গল্প

Icon

মাসুদুল হাসান রনি

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:৩৮ পিএম

এক স্বপ্নবাজ শহুরে কৃষকের গল্প

ছবি : সংগৃহীত

আমার বয়স তখন কত  হবে ? 

১৩ কি ১৪ ,এইরকমই কিছু একটা হবে।  সেই সময়  প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর বিকেলে ফুটবল খেলতে যেতাম  জামতলা ধোপাপট্টির পিছনে বালুর মাঠে। পাড়ার ছোট - বড় সবাই মিলে সারাবিকেল আমরা মাঠ দাপিয়ে বেড়াতাম। প্রচুর ধুলো উড়তো ,তবুও আমাদের খেলার  ছন্দ পতন হত না। সেই মাঠ এখন আর নেই , ডাকবিভাগের  কলোনি গড়ে উঠেছে। মাঝেমাঝে খেলতে আসতেন আমাদের বন্ধু কাজী জাহিদের বড়ভাই, কাজী শাহীদভাইও। 

তখন থেকে শাহীদভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ।  

শাহীদভাইদের পুকুরপাড়ের একতলা বাড়িতে আমাদের বন্ধুদের ছিল অবাধ যাতায়াত । কতদিন, কত বেলা সেই বাড়িতে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটেছে ! তার কোন হিসেব মেলানো যাবে না।

শাহীদভাইর মা , আমাদের খালাম্মাকে বেলা অবেলায় কত  জ্বালিয়েছি ! খালাম্মা সবসময় হাসিমুখে আমাদের সব যন্ত্রনা সয়েছেন ।

ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি খালাম্মা শাহীদভাইকে নিয়ে টেনশান করেন। মাঝেমাঝে বাসায় রাগ করে শাহীদভাই আমাদের টিনের বাসায় এসে রাতে থাকতেন । এমন অনেক দিন গেছে ভোরবেলা খালাম্মা শাহীদ ভাইর খোঁজে  আমাদের বাসায় এসে হাজির । সারারাত তিনি ঘুমাননি । শাহীদভাইর প্রতি তার ভালবাসার প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ,তার অনেক কিছুই আমি দেখে এসেছি ।

শাহীদভাই'র দেখাদেখি  আমার লেখালেখির শুরু । তাঁর সাথেই শুক্রবার বিকেলে আমি যেতাম সাহিত্যসভায় ।

মাঝেমাঝে শাহীদভাইর সম্পাদনায় বের করতাম সাহিত্য পত্রিকা। সেই সব পত্রিকা তরুন উঠতি লেখকদের কাছে অনেক সমাদৃত হয়েছিল ।

একবার আমার সম্পাদনায় একটি ছড়া কার্ডে শাহীদভাইর লেখা একটি ছড়া নিয়ে জামতলায় তুমুল হৈ চৈ , বিচার- শালিশ পর্যন্ত গড়িয়েছিল । মনে আছে, আমি ভয়ে ২ দিন শাহিদভাইদের মহল্লায় যাইনি ।

সেই একরোখা কবি, ছড়াকার শাহীদভাইর সাথে আমার দীর্ঘদিনের পথচলা । কখনো তার লেখালেখির ছায়াসংগী । কখনো পাড়ায় ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার সহযোগী ছিলাম। কখনো তাঁর ঢাকা কলেজ হোস্টেল জীবনে বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে আমার যাতায়াত ছিল নানান কারনে। 

আমি যখন মাস্টার্স শেষ করে বেকার তখন শাহীদভাই তরুন নাট্যকার ও নির্দেশক । সেই সময় আমার দিনের প্রায় সময় কাটে কালিরবাজারস্থ আমান ভবনে হিম কম্পিউটারে । একদিন  সকালে শাহীদভাই এলেন তার লেখা নাটক 'যুথীর মালার পুঁথি মালতি গলার হার' নাটকের স্ক্রীপ্ট কম্পোজ করাতে ।

স্বর্ণপট্টির ভেতর পরান দা'র  চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে শাহীদভাই খোকনভাইয়ের কাছে আক্ষেপ করে বলছিলেন, একজন ভাল প্রডাকশান ম্যানেজার কোথাও পাই না। সবাই ছয় নয় করে । একজন সৎ, বিনয়ী , পরিশ্রমী  প্রডাকশান ম্যানেজার কই পাই? 

হঠাৎ তিনি আমাকে  বললেন, রনি ,তুমি আমার সাথে এই কাজটা কর।'

মিডিয়া নিয়ে আমার তুমুল আগ্রহ। কিন্তু কাজ করার বা শেখার সুযোগ মিলছিল না । এ যে মেঘ না চাইতেই জল!  কিন্তু শাহীদ ভাইয়ের এই কথা শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম ।

আমি আমতা আমতা করে বলি, ভাই আমি তো মিডিয়ার কিছুই জানি না। আমি কি পারব ?

শাহীদভাই অভয় দেন।

' তোমার কাজ আমার টাকা -পয়সার হিসাব রাখা । বাকিটা পরে নিজেই শিখে যাবা।'

সেই প্রথম লাইট, একশান , ক্যামেরার সাথে আমার পরিচয়। প্রথম কাজে তিনি কতটা সন্তস্ট হয়েছিলেন,তা আজো জানি না।

তারপর শাহীদভাইয়ের কাছে দীর্ঘ ছয় বছর টানা সহকারী হিসেবে কাজ শেখা । মিডিয়ার কত কিছুই না তাঁর কাছে শিখেছি । জাহাঙ্গীরনগর ফিল্ম সোসাইটির সাথে আমাকে যুক্ত করা, আমান ভবন হয়ে পুরানা পল্টনে গ্রাম থিয়েটারের হুমায়ুন কবির হিমুভাইদের বিল্ডিংয়ে অফিস, দৈনিক সংবাদে সিনেমার পাতা জলসায় লেখার সুযোগ করে দেয়া, পান্থপথের অফিস, পাগলায় গোডাউন ভাড়া, এলিফ্যান্ট রোডে ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটিজের সাথে ভাগাভাগিতে অফিস করা --কত কিছুই না আমরা করেছি ! 

শাহীদভাইয়ের গল্প লিখে শেষ করা যাবে না।  একজীবনে তিনি যা যা করেছেন সেই গল্প অনেকের কাছে রূপকথা মনে হবে। ছাত্র রাজনীতির তুখোড় সংগঠক, সাংস্কৃতিক কর্মী, আবৃত্তি শিল্পী, থিয়েটার কর্মী, টেলিভিশনে উপস্থাপনা ও অভিনয়, স্বল্পকালীন সময় এনজিওতে চাকুরী,বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপি রাইটার, দৈনিক পত্রিকায় সাংবাদিকতা, ছিন্নমুল বস্তিবাসীদের মাঝে নাটকের দল গড়ে তোলা, টেলিভিশন নাটক পরিচালনা, পথনাটক ও গানের দল নিয়ে সারাদেশ ঘুরে বেড়ানো থেকে শুরু করে তিনি কিনা করেছেন? 

প্রাণ ও জৈব কৃষিরক্ষায় নিরবে নিভৃতে একাই আন্দোলন করছেন। এই কৃষিকাজের জন্য শহুরে জৌলুশ চাকচিক্য বিপুল অর্থের হাতছানি তাকে কখনোই বেঁধে রাখতে পারেনি। এই শতকের শুরুতে টেকেরহাটে জমি বর্গা নিয়ে কীটনাশক বিহীন বিষমুক্ত কৃষিকাজের আত্মনিয়োগ করেন। 

টেকেরহাটের সাফল্যে পরবর্তী সময় শ্রীমঙ্গল চলে আসেন।এবার বর্গা নেয়া জমি নয়,নিজের জমিতে চাষাবাস শুরু করেন। সামান্য কিছু জমি কিনে যার সুচনা করেছিলেন আজ তার ব্যপ্তি অনেক বেড়েছে। যে মানুষ একসময় হাজার মানুষের নেতৃত্ব দিয়েছে, কোলাহল হৈ চৈ তে সময় কাটাতো, সেই মানুষ শহুরের সব বিত্ত বৈভবের মায়া  উপেক্ষা করে ফিরে গেছেন নিভৃত পল্লীতে, কৃষিকাজে। 

যাহোক, আমি জানি শাহীদভাই কৃষিকাজ কেন করেন। আপনাদের ধারণাই নেই তিনি নিরবে আমাদের কৃষির কি উপকার করছেন। সারা বাংলাদেশের এক প্রান্ত হতে  আরেক প্রান্তের গ্রামে গঞ্জে হাটে মাঠে রোদে বৃষ্টিতে ঘুরে ঘুরে  হারিয়ে যাওয়া ধান ও অন্যান্য শষ্যবীজ সংগ্রহ করে ছোটখাটো ভান্ডার গড়ে তুলেছেন। শাহীদভাই যে সব ধানের বীজ ও শষ্যবীজ সংগ্রহ করেছেন সেগুলো বিগত ২০/২৫ বছর  কিংবা আরো আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই বীজগুলো বাংলাদেশের কৃষির অমূল্য সম্পদ ছিল। সংগৃহীত বীজ তিনি বাণিজ্যিক কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন না। নিজে উৎপাদনের পর সেই বীজ আবার সংরক্ষন করেন। কেউ আগ্রহী হলে হয়ত কিছু বীজ দিয়ে থাকেন। 

মনে পড়ে, দেশ ছেড়ে আসার বেশ কিছুদিন আগে হুট করে একদিন শাহীদভাইয়ের সাথে চলে গিয়েছিলাম জামালপুরের সানন্দাবাড়ি হাটে। কুসুমফুলের বীজের খোঁজে। সেখান হতে প্রমত্ত যমুনা পাড়ি দিয়ে গিয়েছিলাম গাইবান্ধায়। বলা নেই কওয়া নেই এরকম হুটহাট কতদিন শাহীদভাইয়ের সাথে বের হয়ে পড়েছি! 

আজ আমার এতদুর উঠে আসা,মিডিয়ায় কিছু করে -কেটে খাওয়া ,সব কিছুই এই একটি মাত্র মানুষের জন্যই সম্ভব হয়েছে । তাঁর এই অসামান্য অবদান, সহযোগিতা না থাকলে হয়ত আমার জীবনটাই ভিন্নপথে চলে যেত। সেই মানুষটিকে কখনোই সামনা সামনি বলতে পারিনি ,শাহীদ ভাই আপনি সেদিন আমাকে সুযোগ করে না দিলে আজ আমি -আমি হতে পারতাম না । 

আজ নাট্যকার, নির্দেশক ,অভিনেতা কাজী শাহীদুল ইসলাম এর জন্মদিন । জন্মদিনে অনেক শ্রদ্ধা ও শুভকামনা শাহীদ ভাই ।

Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন