Logo
Logo
×

বিশেষ সংবাদ

আয়নাঘরের উদ্ভাবক তারিক সিদ্দিক : নির্যাতন-গুম করতেন রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক :

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ০১:৪৮ পিএম

আয়নাঘরের উদ্ভাবক তারিক সিদ্দিক :  নির্যাতন-গুম করতেন রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে

ছবি - সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার গুম কমিশন গঠন করে। এ গুম কমিশন আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের আমলে সংঘটিত গুম নিয়ে তদন্ত করছে। এ তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে এখন পর্যন্ত ১৮৩৭টি গুমের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, গুমের সংখ্যা আরও কম হবে। এ গুমের অভিযোগগুলোর মধ্যে ১৭৭২টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করেছে কমিশন। এ গুম হওয়া মানুষদের মধ্যে ১৪২৭ জন অর্থাৎ ৮১ শতাংশ ফিরে এসেছে। ৩৪৫ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।

ধারণা করা হয় যে, এ গুম হওয়া মানুষগুলো আর ফিরে আসেনি, তারা আর পৃথিবীতে নেই। তাদের হত্যা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন আমলের সবচেয়ে ঘৃণ্য জঘন্য বিষয়টি ছিল গুম এবং খুন। গুম-খুন করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছিল, প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ‘আয়নাঘর’। যে কোনো বিরুদ্ধ মত বা পথের মানুষ যিনি সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা অন্য কোথাও সরকারের ন্যূনতম সমালোচনা করতেন, তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো আয়নাঘরে। এ আয়নাঘর ছিল একটা ভয়ংকর নির্যাতন কেন্দ্র। যেখানে বিরোধী মতের লোকজনকে ফ্যাসিস্ট কায়দায় নির্যাতন-নিপীড়ন করা হতো। যদি তারা বশ্যতাস্বীকার না করত, তা হলে তাদের হত্যা করা হতো। এ ঘটনা ২০০৯ সাল থেকে নিয়মিতভাবে ঘটে আসছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে, স্বৈরাচারী শাসন পাকাপোক্ত করতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় ‘আয়নাঘর’ প্রতিষ্ঠা করে। আর এ আয়নাঘরের উদ্ভাবক হলেন তারিক সিদ্দিক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের মাফিয়াতন্ত্রের অন্যতম প্রধান। তারিক সিদ্দিকের দায়িত্ব ছিল যে কোনো অবস্থাতেই যেন বিরুদ্ধ মত মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে

গণতন্ত্রের অন্যতম শক্তি হলো পরমসহিষ্ণুতাঅন্যের মতকে শ্রদ্ধা জানানো এবং অন্যের মত প্রকাশের অধিকারকে নিশ্চিত করা। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে ঠিক উল্টো পথে হেঁটেছে। বিরুদ্ধ মত দমন করে যে কোনো প্রকারে ক্ষমতায় টিকে থাকাই ছিল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। আর সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তৈরি করা হয় ভয়ংকর ‘আয়না ঘর’। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তারিক সিদ্দিক যে এত বেপরোয়া এবং অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠেছিলেন তার অন্যতম কারণ ছিল ‘আয়নাঘর’। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণের পর ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য করণীয় নির্ধারণ করতে থাকেন। এ সময় তাকে ‘আয়নাঘর’ প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন তারিক সিদ্দিক। আর এ আয়নাঘরের মাধ্যমে বিরোধী দল, বিরোধী পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিছু দুর্নীতিবাজ, অসৎ সামরিক এবং আইনশৃঙ্খলা কর্মকর্তার সহযোগিতায় এ ‘আয়নাঘর’ প্রতিষ্ঠা করেন তারিক সিদ্দিক। এ ‘আয়রাঘরে’র মাধ্যমেই আসলে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট রেজিমের সূচনা হয়েছিল।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ‘আয়নাঘর’ প্রতিষ্ঠার জন্য কতগুলো ধাপ ছিল। তারিক সিদ্দিকের নির্দেশনায় প্রথমে বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতা এবং বিরোধী পক্ষের লোকজনের কথাবার্তা আড়িপাতা শুরু হয়। আড়িপাতার মাধ্যমে বিরোধী দলের কে কী করছেন বা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন ইত্যাদি পুরোটা নজরদারিতে রাখার ব্যবস্থা করা হয়, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। নজরদারি থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে যারা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, যারা সরকারের সমালোচনা করছেন, তাদের প্রথমে ভয়ভীতি দেখানো হয়। এতে কাজ না হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো ডিজিএফআই অফিস অথবা র‌্যাবের কার্যালয়ে। সেখানে তাদের ভয়ভীতি এবং হুমকি দেওয়া হতো। এরপরও যদি দেখা যেত যে বিরুদ্ধ মত প্রকাশকারী ব্যক্তিটি কথা শুনছেন না বা বাধ্য হচ্ছেন না, তখন তার ওপর নেমে আসত ভয়াবহ নির্যাতন এবং নিপীড়ন। তাকে নিয়ে যাওয়া হতো আয়নাঘরে।

সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে আয়নাঘরের কথা বলা হয়েছে। গুম কমিশনের প্রতিবেদনেও আয়নাঘরের কথা বলা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আয়নাঘর পরিদর্শন করেছেন। সেখানে নির্যাতনের ভয়াবহ সম্পর্কে তিনি জেনেছেন।

আয়নাঘরে যাদের নিয়ে যাওয়া হতো তারা প্রধানত তিন ধরনের ব্যক্তি ছিলেন। প্রথমত, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যক্তি। দ্বিতীয়ত, যারা সামাজিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করা সক্রিয় ব্যক্তি। তৃতীয়ত, ব্যক্তিগত ক্ষোভ আক্রোশ এবং অর্থ আদায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আয়নাঘরে যাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ব্যক্তি ছিলেন বিএনপির। গুম কমিশনের তথ্য অনুযায়ী বিএনপির ৩৭ জন, ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৩১, জামায়াতে ইসলামীর ২৫, ইসলামী আন্দোলনের দুজন, হেফাজতে ইসলামের দুজন, আওয়ামী লীগের দুজন, খেলাফত মজলিসের দুজন, তাবলিগ জামায়াতের একজনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এসব রাজনৈতিক পরিচয় থাকার বাইরেও কিছু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, যেমন- জামায়াতের সাবেক আমির এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গোলাম আজমের ছেলে সেনা কর্মকর্তা আযমীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে ব্যক্তিগত আক্রোশের জেরে।

এভাবে সশস্ত্রবাহিনী থেকে বেশ কিছু কর্মকর্তা, যারা তারিক সিদ্দিকের দুর্নীতি, অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারিতার বিরোধিতা করতেন তাদের গুম করা হয়েছিল। অনেকেই তারিক সিদ্দিকের কাছে বশ্যতাস্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে তাদের গুম করা হয়েছিল। তারিক সিদ্দিক চেয়েছিলেন সশস্ত্রবাহিনীতে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব তৈরি করতে। সেখানে সেনাপ্রধানের ক্ষমতার চেয়ে তার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ থাকবে। তিনি যেটি বলবেন সেটিই চূড়ান্ত হবে। এ মতের যারা বিরোধিতা করত, যারা তারিক সিদ্দিকের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করত তাদের প্রথমে সশস্ত্রবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হতো। তার পর তাদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো আয়নাঘরে।

তারিক সিদ্দিক বিরুদ্ধ মত দমনের জন্য গুমের পাশাপাশি ক্রসফায়ারকে আরও ব্যাপক বিস্তৃত করেছিলেন। র‌্যাবের সঙ্গে তারিক সিদ্দিকের নিয়মিত যোগাযোগ হতো। র‌্যাবের মাধ্যমে তিনি আসলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করতেন। সেই কৌশলের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের তালিকা তৈরি করা হতো। তারিক সিদ্দিক বিষয়টি নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতেন। শেখ হাসিনার সবুজ সংকেত পেলেই তিনি এসব ব্যক্তিকে ক্রসফায়ারে দিতেন। এসব ঘটনার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বিএনপির সিলেট অঞ্চলের জনপ্রিয় নেতা ইলিয়াস আলী। ইলিয়াস আলী সরকারের কঠোর সমালোচক ছিলেন। তার কারণে সিলেট অঞ্চলে বিএনপির একটি জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছিল। একাধিকবার চেষ্টা করা হয়েছিল ইলিয়াস যেন তারিক সিদ্দিকের বিরুদ্ধে কথা না বলেন। কিন্তু সেটিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। এরপর তাকে গুম করা হয়। এখন পর্যন্ত পরিবার তার হদিস পায়নি। কক্সবাজারের একরাম চৌধুরীর ঘটনাও তাই।

অর্থাৎ তারিক সিদ্দিকের যদি কেউ খারাপ দৃষ্টিতে পড়ত, তাকে হয়তো গুম করা হতো, নয়তো ক্রসফায়ারে নেওয়া হতো। প্রথমদিকে এটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলেও আস্তে আস্তে তারিক সিদ্দিক তার ব্যবসায়িক দুর্নীতি এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবহার শুরু করেন। গুম পরবর্তীতে হয়ে যায় তারিক সিদ্দিকের ব্যক্তিগত লুটপাটের হাতিয়ার। এটাই মাফিয়াতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। কোনো ব্যক্তির জমি তিনি দখল করতে চাইলে, যদি দেখা যায় যে, সেই ব্যক্তি তাকে বাধা দিচ্ছে, সে ক্ষেত্রে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো এবং শেষ পর্যন্ত তাকে ওই জমি দিতে বাধ্য করা হতো।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গাজীপুরে তারিক সিদ্দিক তার নিজের এবং শেখ হাসিনা পরিবারের নামে যে বিঘায় বিঘায় জমি কিনেছেন, তার সবই দখলকৃতএসব জমির মালিকদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলমাসের পর মাস তাদের আয়নাঘরে জিম্মি করে রাখা হয়েছিলশেষ পর্যন্ত তারা এসব দলিলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিলেন

উল্লেখ্য, তারিক সিদ্দিক গাজীপুরে বাগানবাড়ি করেছেন এবং সেখানে টিউলিপ সিদ্দিকের নামেও একটি বাগানবাড়ি রয়েছে। আছে শেখ রেহানার বাগানবাড়ি। এসবই করা হয়েছে জমির প্রকৃত মালিকদের উঠিয়ে নিয়ে, হুমকি দেখিয়ে, আয়নাঘরে রেখে। আয়নাঘরের কাজ ছিল বহুমাত্রিক। প্রথমত, এ আয়নাঘরের মাধ্যমে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা ছিল। দ্বিতীয়ত, তারিক সিদ্দিকের অবাধ, দুর্নীতির অস্ত্র ছিল আয়নাঘর। তৃতীয়ত, যারা তারিক সিদ্দিক দুর্নীতির তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো আয়নাঘরের মাধ্যমে। চতুর্থত, দখলদারি, চাঁদাবাজির জন্য আয়নাঘর ব্যবহার করা হতো। এরকমও অভিযোগ আছে যে, বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার দাবি করা হতো। ব্যবসায়ী টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে আয়নাঘরে নিয়ে গিয়ে কয়েকদিন বন্দি করে রাখা হতো। অবশেষে প্রাণের ভয়ে ওই ব্যবসায়ী টাকা দিতে রাজি হতো। আয়নাঘর শেষ দিকে হয়ে উঠেছিল চাঁদাবাজির অস্ত্র। এভাবে তারিক সিদ্দিক বাংলাদেশে একটি মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করেছিলেন, যার গডফাদার হয়েছিলেন তিনি নিজে।


Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন