
প্রিন্ট: ২৮ আগস্ট ২০২৫, ০৮:১২ এএম
তারিক সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার :
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ০৩:৫৪ পিএম

ছবি-সংগৃহীত
চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রিত শেখ রেহানার দেবর জেনারেল তারিক সিদ্দিকী জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীর দন্ডমুন্ডের কর্তার হরেক রকমের দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার দুর্নীতির তালিকায় অন্যতম সংযোজন ছিল টাইগার আইটি। দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত এ বাংলাদেশি কোম্পানি এবং এর সঙ্গে তারিক সিদ্দিকের সংশ্লিষ্টতার কাহিনী এখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে টাইগার আইটির তৎপরতা থামেনি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে।
জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি কার্ড) প্রকল্পে ঘুষ লেনদেনের দায়ে ওবাথুর নামে ফরাসি প্রতিষ্ঠান ও এনআইডি প্রকল্পে দুর্নীতি,এনআইডি প্রকল্পের ঘটনাপ্রবাহ শুরু হয় ২০১১ সালে। ওই সময় বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ডিজিটালাইজড বায়োমেট্রিক ভোটার-নিবন্ধন প্রকল্পের জন্য ১৯৫ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা) ঋণ অনুমোদন করে। যদিও নির্বাচন কমিশন এই চুক্তির তদারকি করছিল, এর প্রকল্প ইউনিটে মূলত সামরিক কর্মকর্তারা বেসামরিক দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। এই সামরিক ব্যাক-চ্যানেলটি পরে সিদ্ধান্তমূলক ছিল বলে প্রমাণিত হয়।
কয়েক বছর ধরে প্রাথমিক কাজ করার পর, কমিশন ২০১৪ সালের এপ্রিলে দরপত্র আহ্বান করে। প্যারিসভিত্তিক নিরাপত্তা মুদ্রণ সংস্থা ওবাথুর টেকনোলজিস এই কাজ পায়। এর বাংলাদেশি সাব-কন্ট্রাক্টর ছিল টাইগার আইটি। এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে ছিলেন জনৈক জিয়াউর রহমান। বিশ্বব্যাংকের তদন্তকারীরা পরে আবিষ্কার করেন, প্রথম দরপত্র জমা দেওয়ার অনেক আগেই সবকিছু সাজানো হয়েছিল।
টাইগার আইটি নতুন নাম 'স্বরবর্ণ ধারণ করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এখনও গ্রামীণফোন, এনটিএমসি, পাসপোর্ট অফিস এবং কয়েকটি ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী। নতুন নামের মুখোশ পরলেও টাইগার আইটির সব মালমসলা, উপকরণ ও সাজসরঞ্জাম বাংলাদেশের টেলিকম খাতের নিয়ামক ভূমিকা পালন করছে। গ্রামীণফোন, রবি ও এনটিএমসির সিকিউরিটি অপারেশন সোটার (এসওসি) পরিচালনার পুরো দায়িত্ব তারা পালন করছে।
দরপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার আট মাস আগে, জিয়াউর রহমান, ওবাথুর এবং অন্য একটি সরবরাহকারীকে ভবিষ্যতের চুক্তির গোপনীয় শর্তাবলি বিবরণের একটি অনুলিপি ই-মেইল করেছিলেন। অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঠেকিয়ে দেওয়া যায় এমন ধারাগুলোতে তাদের মতামত চাওয়া হয়। তিনি উভয় কোম্পানিকে কাজে লাগিয়ে দরপত্রটিকে এত সুনির্দিষ্টভাবে পুনর্গঠন করেছিলেন যে প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থাগুলোর শর্তাবলি পূরণ করা প্রায় অসম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক তদন্তকারীরা বলছেন, জিয়াউর রহমানের এই বিশেষ অভ্যন্তরীণ তথ্যপ্রাপ্তি তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে তার সম্পর্কের কারণে সম্ভব হয়েছিল।
নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চুক্তিটি চূড়ান্ত করে এবং এক মাস পরে স্বাক্ষর করে। এর পরপরই তারিক সিদ্দিক মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিশ্চিত করেন, যাতে কার্ডের অর্ডার ৭০ মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ৯০ মিলিয়ন করা যায়। এর বিনিময়ে ওবাথুর ৭ লাখ ৩০ হাজার ইউরো ঘুষ দিতে সম্মত হয়। কৌশল হিসেবে এই বিলটি প্রশিক্ষণ কোর্সের নামে দেওয়ার কথা হয়, যদিও কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি। ফরাসি তদন্তকারীরা এই অর্থ প্রদানের তথ্য ২০১৫ সালের মার্চে খুঁজে পান।
১০ দশমিক ৮ মিলিয়ন ইউরোর হলোগ্রাম চুক্তির প্রায় অর্ধেক- প্রায় ৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ইউরো- তারিক সিদ্দিকের জন্য নির্ধারিত ছিল বলে ফরাসি নথিতে উল্লেখ অগ্রিম পরিশোধ করার ক্ষেত্রে সতর্ক ছিলেন।
এদিকে প্যারিস এবং লন্ডনে যখন আইনজীবীরা এবং পুলিশ হিসাবপত্র এবং যোগাযোগের চেইন নিয়ে কাজ করছিল, তখন তাদের নিজ নিজ সরকার সেই জেনারেলকেই প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল। ২০২০ সালের প্রথম দিকে- একটি চলমান দুর্নীতি তদন্তের কয়েক বছর পরেও ফ্রান্সের বিমানবাহিনী প্রধান জেনারেল ফিলিপ লাভিন ঢাকা সফর করেন এবং তারিক, সিদ্দিকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করেন। এই সফরই পরবর্তীতে সশস্ত্র বাহিনীর মন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লির ঢাকা সফর এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর পারস্পরিক রাষ্ট্রীয় সফর, ড্যাসল্ট রাফাল যুদ্ধবিমান এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির জন্য ফ্রান্সের আগ্রাসী প্রচেষ্টার অংশ ছিল। তারিক সিদ্দিক কার্যত বাংলাদেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ভূমিকা পালন করেন। এই ধরনের কেনাকাটার আলোচনায় তিনি নির্ধারক প্রভাব রাখতেন।
জানা যায়, তারিক সিদ্দিকের পরিবার দেশে এবং বিদেশে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। গত জানুয়ারিতে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, তার স্ত্রী শাহীন সিদ্দিক, তার এবং তাদের মেয়ের জন্য একাধিক 'গোল্ডেন পাসপোর্ট পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংক স্টেটমেন্টে তার নামে ২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার দেখিয়ে গোল্ডেন ভিসা পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তার নামে মালয়েশিয়ায় আরও রিয়েল-এস্টেট হোল্ডিং খুঁজে পেয়েছে।
মেয়ে বুশরা সিদ্দিক ২০১৮ সালে তার স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে যুক্তরাজ্যের ভূমি রেজিস্ট্রি রেকর্ড অনুযায়ী, তাদের কলেজ শেষ করার মাত্র দুই বছর পর এবং একটি ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি বাড়ি কিনেছিলেন। ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম শেষ করার কয়েক মাস পরেই এটি কেনা হয়। তবে কথিত ঘুষের টাকায় সম্পত্তিটি কেনা হয়েছে- এমন কোনো প্রমাণ নেত্র নিউজ পায়নি।
টাইগার আইটি কোম্পানিকে নিয়ে প্রচন্ড সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। তবে বিআরটিএ অথরিটি নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য নানা কথা বলে যাচ্ছে এবং নিজেদের নির্দোষ দাবি করছে। তাদের দাবি অনুযায়ী, মূল্যায়ন কমিটির যারা টাইগার আইটিকে কাজ দিয়েছিল তাদের কেউ এখন আর নেই। কাজেই অভিযোগ প্রমাণ করা সহজ হবে না।
হাসিনার আমলে যখন টাইগার আইটিকে টেন্ডার দেওয়া হতো তখন প্রকল্পের খরচ ইচ্ছামতো ধরা হতো। এতে করে সরকারের ক্ষতি হলেও ঠিকাদারি এই প্রতিষ্ঠান বেশি লাভবান হচ্ছে। বিআরটিএর স্মার্টকার্ড নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে এবং তাতে গ্রাহকদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে টাইগার আইটির দুর্নীতি ও অবহেলার কারণেই।
জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন, ঢাকা ওয়াসা, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, এনআইডি অনুবিভাগের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে বাংলাদেশে আইবিসিএস-প্রাইমেক্স নামে ছদ্মবেশী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কয়েকশ কোটি টাকার কাজ করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এর সবকিছুই অডিট ও মূল্যায়ন ছাড়াই ।