Logo
Logo
×

বিশেষ সংবাদ

কাছিমের সমুদ্রযাত্রা

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক :

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ১২:৩৪ পিএম

কাছিমের সমুদ্রযাত্রা

ছবি - টেকনাফের শামলাপুর সৈকত থেকে কাছিমের শরীরে স্যাটেলাইট যন্ত্র ছেড়ে দেওয়া হয়

গত ২৭ এপ্রিলের সকালটা ছিল সত্যিই অসাধারণ। টেকনাফের শামলাপুর এলাকায় শতাধিক কাছিমের বাচ্চাকে দেখলাম সাগরে ফিরে যেতে। বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন জলপাইরঙা কাছিমের বাচ্চাগুলোকে নিজ হাতে ছেড়ে দেওয়ার আনন্দটাই অন্য রকম। গত চার মাসে এ সংখ্যা এখন ১০ হাজার। ভাবতেই অবাক লাগছে, একটি ছোট্ট উদ্যোগ থেকে এ বছর ১০ হাজার ৫৩টি কাছিম সমুদ্রে ফিরে গেছে। আমার কাছে এ বছর সবচেয়ে সেরা খবর এটিই। বাচ্চাগুলো সমুদ্রে ফিরে গিয়ে কী অবস্থায় আছে, তা আমাদের জানা নেই। তবে এরা যে ডিম থেকে ফুটে বাচ্চা হয়ে নিজ বিচরণস্থলে ফিরতে পেরেছে, এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে!

প্রতিবছর আমাদের সৈকতগুলোতে শীতকালে শত শত মা কাছিম আসে ডিম পাড়তে। শত কিলোমিটার সৈকত এলাকায় তারা দিনের পর দিন অপেক্ষা করে ডিম পাড়ার জন্য। সৈকতের বালুচরে যখন তারা নিরাপদ মনে করে, তখনই ডিম পাড়ে। আমাদের সৈকতগুলো তাদের জন্য এখন মোটেও নিরাপদ জায়গা নয়। পুরো অঞ্চলেই মানুষের পদচারণ, কুকুরের অত্যাচার, জেলেদের মাছ ধরার জাল আর হোটেলের ঝলমলে আলো। সব মিলিয়ে তাদের ডিম পাড়ার জায়গা নেই বললেই চলে। আর কাছিমগুলো ডিমগুলো পাড়তে পারলেও বেশির ভাগ সময় ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এ রকম বাস্তবতায় টেকনাফের শামলাপুর সৈকত এলাকায় বেসরকারি সংস্থা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (কোডেক) প্রায় ৪০ কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে কাছিমের ৫টি হ্যাচারি করেছে। মূলত তারা কাছিমের ডিমগুলো থেকে নিরাপদে যেন বাচ্চা পাওয়া যায়, তার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ বছর এ কাজে সহযোগিতার জন্য আইইউসিএন ও জিআইজেড এগিয়ে এসেছে।

গত শীত মৌসুমে পুরো এলাকায় পাওয়া গেছে ১২৯টি মা কাছিমের বাসা। সেখান থেকে কোডেকের কর্মীরা সংগ্রহ করেছেন ১৪ হাজার ৭২২টি ডিম। ডিমগুলো সংগ্রহের পর প্রাকৃতিকভাবেই ডিমগুলো বালুর ভেতর পুঁতে রাখা হয়। প্রতিটি কাছিমের বাসা থেকে আনা ডিমগুলো আলাদা করে রাখা হয়, যাতে ডিমগুলো থেকে বেশি বাচ্চা পাওয়া যায়। এ বছর সব মিলিয়ে বাচ্চা পাওয়া গেল ১০ হাজার ৫৩টি। বাচ্চা ফোটার হার প্রায় ৬৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। সব বাচ্চাই নিরাপদে সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

সাগরে বাচ্চা ছেড়ে দেওয়ার পর বাচ্চাগুলো কোথায় যায়? গবেষণা বলছে, এসব ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার পর প্রথম সাত দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় বাচ্চারা তেমন কিছু খায় না। সাঁতার কাটা শেখে। কাছিমের বাচ্চার নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে। ফোটার পরপরই এরা সাগরে ফিরে যেতে চায়। ভাটার সময় এদের ছাড়লে আরও ভালো। এ সময় এরা একটানা সাঁতার কাটে। এক ইঞ্চি আকারের এই বাচ্চারা মূলত খুঁজতে থাকে তাদের নিজস্ব বিচরণভূমি। এই এলাকাটি গভীর সমুদ্র, যেখানে প্লাঙ্কটনসহ তাদের খাবার আছে। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে এই পথটুকুন যেতে বেশির ভাগ কাছিমের বাচ্চারই মৃত্যু হয়। বেঁচে থাকে শতকরা দেড় ভাগ। এই কাছিমগুলো বড়। বিচরণ করে সমুদ্রজুড়ে। তারপর প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী কাছিমরা আবার ফিরে আসে একই জায়গায়। যেখান থেকে তার জন্ম হয়েছিল। এটি কাছিমের জীবনের গল্প।

বাচ্চা কাছিম কোথায় যায়, তা আমাদের সুনির্দিষ্টভাবে জানা নেই। তবে মা কাছিম ডিম পেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে—এ খবর আমরা জানি। গত ১০ ফেব্রুয়ারি আমরা টেকনাফের শামলাপুর সৈকত থেকে ৪টি কাছিমের শরীরে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়ে দিই। মূলত মা কাছিমগুলো ডিম পেড়ে কোথায় যাচ্ছে, তার গতিবিধি দেখাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। এর মধ্যে একটি কাছিম ১৪৪ দিনে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্ব উপকূলের মুল্লাইথিভু জেলায় পৌঁছেছে। এরা আমাদের সমুদ্র এলাকা ছেড়ে এখন ভারত মহাসাগরে রয়েছে। অন্য তিনটি কাছিমও কমবেশি দুই কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণ করেছে। পরের শীতে তারা ডিম পাড়তে নিশ্চয় আবার ফিরে আসবে আমাদের সৈকতে।
জলপাই রঙের এ কাছিমের প্রজাতিটি পৃথিবীব্যাপী সংকটাপন্ন হলেও তা সংরক্ষণে আমাদের উদ্যোগ নেই বললেই চলে। আমাদের সমুদ্র উপকূলে শত কিলোমিটার সৈকতের মধ্যে অন্তত পাঁচ কিলোমিটারের একটা নিরাপদ সৈকত করা গেলে শত শত মা কাছিম নিরাপদে ডিম পাড়তে পারবে। আমাদের কক্সবাজার-টেকনাফের পুরো সৈকত এলাকায় ডিম পাড়ার মৌসুমে অন্তত কিছু জলজ এলাকা জালমুক্ত করাও খুবই জরুরি।

এ দেশে সামুদ্রিক কাছিমের প্রায় পাঁচটি প্রজাতি আছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে জলপাইরঙা কাছিমই ডিম পাড়তে আমাদের সৈকতে আসে। তবে সবুজ কাছিম নামের আরেকটি কাছিমও মাঝেমধ্যে দেখার তথ্য আছে। অন্য প্রজাতিগুলো খুবই বিরল। এই কাছিম প্রজাতিগুলো সংরক্ষণে আমাদের তেমন কোনো বড় উদ্যোগের দরকার নেই। কাছিমের ডিম পাড়ার জন্য চাই নিরাপদ এক খণ্ড বালুময় সৈকত। সরকারিভাবে এ উদ্যোগ নেওয়াটা খুবই জরুরি।

Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন