নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা মত
অনলাইন ডেস্ক :
প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৫, ০৮:২৮ পিএম
বর্তমান ‘প্রথম বিজয়ী’ (এফপিটিপি) নির্বাচন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা দূর করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি কার্যকর, ন্যায্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘সংখ্যানুপাতিক’ (পিআর) ও ‘মিশ্র সদস্য অনুপাত পদ্ধতি’ (এমএমপি) বিষয়ে গঠনমূলক সংলাপের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বিশ্লেষক ও ইসলাম-ভিত্তিক দলগুলোর নেতারা।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস-এর উদ্যোগে ‘জনমত প্রতিফলনে কার্যকর নির্বাচন পদ্ধতি: এমএমপি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকটি বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকাল ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত রাজধানীর রিপোর্টার্স ইউনিটির শফিকুল কবির মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক। তিনি বলেন, ‘ইসলামে শাসক নির্বাচনের স্বতন্ত্র ব্যবস্থা রয়েছে, যা নিঃসন্দেহে সব ব্যবস্থার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম। ইসলামী ব্যবস্থা কার্যকর না থাকায় এখন বিকল্প হিসেবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচনকে মন্দের ভালো হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানারকম নির্বাচনব্যবস্থা রয়েছে। তার মধ্যে আমাদের দেশে বর্তমানে কার্যকর রয়েছে এফপিটিপি পদ্ধতি। সম্প্রতি বিভিন্ন মহল ও রাজনৈতিক দল ও পক্ষগুলো পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি তুলেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘উভয় পদ্ধতির নানারকম দুর্বলতা ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণমানুষের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস তৃতীয় পদ্ধতি তথা এমএমপি প্রস্তাব করেছে। এটিই তুলনামূলকভাবে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হতে পারে। এতে জনমতের সঠিক প্রতিফলন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ভোটারের ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা বিগত ১৭ বছর ভোট দিতে পারিনি। এজন্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ। বর্তমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় ভোটকে একটি ব্যবসায় পরিণত করা হয়েছে। মনোনয়ন বাণিজ্য একটি সাধারণ কাজে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনি ব্যয় নির্ধারণ করেছে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু সেটা মাঠ পর্যায়ে কোটি ছড়াবে নিশ্চিত। এটাকে বন্ধ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। এমএমপি ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নীতিগতভাবে এমএমপির সঙ্গে সমর্থন জানাচ্ছে।’
গোলটেবিল আলোচনায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী বলেন, ‘পিআর ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। সংবিধান পরিবর্তন করার ম্যান্ডেট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেই। তাই বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় নির্বাচন করে পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে।’
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ‘৪০টি দেশে পুরোপুরি পিআর পদ্ধতি আছে। কিছু দেশে মিক্সড পদ্ধতি আছে। যারা বলছেন, পিআর বোঝেন না, এটা তাদের অজ্ঞতা।’ মিক্সড পদ্ধতির পিআর চালু হতে পারে বলেও মত দেন তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘আমরা নতুন ব্যবস্থা চাই। পুরানো ব্যবস্থায় থাকা খুব দুঃখজনক। আমরা আশ্চর্য হচ্ছি—অনেক সিনিয়র রাজনীতিবিদ বলছেন, বড় দলের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। তাহলে এই অভ্যুত্থান কি কোন দলের কথায় হয়েছে? অন্যদের প্রস্তাব ইগনোর করা যাবে না। নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি অথবা মিক্সড পদ্ধতিতে যেতে পারি। তবে সংস্কার বিষয়ে সবার একমত হতে হবে।’
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমাদের প্রস্তাবনা হলো, সংসদের বিদ্যমান আসন থাকবে। এর বাইরে সংরক্ষিত আরও ১০০ আসন যুক্ত হবে, যেখানে সব ধর্ম, বর্ণ ও গোষ্ঠীর মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। বিদ্যমান ৩০০ আসনের মধ্যে ২০০ আসন আগের পদ্ধতিতে থাকুক। বাকি ১০০ আসনে পিআর হোক। এতে আমরা ধীরে ধীরে পিআরের মধ্যে যাবো। যাতে পরবর্তী সময়ে কোনও সমস্যা হলেও সেটা সমাধানযোগ্য হয়। পাশাপাশি জাতি ও রাষ্ট্রে এই পদ্ধতি কতটা ইতিবাচক হয়, সেটাও বোঝা যাবে। তবে কোনও না কোনও পর্যায়ে বাংলাদেশে পিআর সংযোজন করতেই হবে। পুরোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ইতিমধ্যে পিআরে যুক্ত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে কারণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, একই কারণে জাতীয় পার্টিকে কেন নিষিদ্ধ করা হবে না?’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘ইসলামী আন্দোলন ২০০৮ থেকে পিআর পদ্ধতির আলোচনা করে আসছে। বিশ্বের ৫৪টি দেশে এটি চালু আছে। কোন দল এটি না বুঝলে তাদের অজ্ঞতা। তাই বলে এই পদ্ধতি নিয়ে বিদ্রুপ করার সুযোগ নেই। যারা পিআরের বিরোধিতা করছে, তারা তাদের স্বার্থ দেখছে। তাহলে অন্যদের দাবিকে কেন নেগেটিভভাবে দেখা হচ্ছে? দুর্বলতাগুলো কিভাবে কাটানো যায় তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বড় কথা হলো- নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করতেই হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ফয়জুল হক বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে আলেমরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এটাতে থাকলে যতই জোট করেন, বেশি আসন পাবেন না। আরও গোলামী করে যেতে হবে। পিআর হলে অনেক বেশি আসন পাবেন। কোনভাবেই ফ্যাসিবাদকে ফেরার সুযোগ দেওয়া যাবে না। যারাই আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতি দেখাবে, তারাই দেশ এবং গণঅভ্যুত্থানের শত্রু।’
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী বলেন, ‘পিআর যৌক্তিক। মিক্সড পদ্ধতি আরও যৌক্তিক মনে হচ্ছে। তবে ফ্যাসিবাদ যাতে কোনভাবে ফিরে না আসে, সেজন্য সবাইকে ঐকমত্য থাকতে হবে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক আতিক মুজাহিদ বলেন, ‘১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের কোনো সনদ হয়নি। এটা দুঃখজনক। আমাদের ভাবতে হবে কোন পদ্ধতিতে রাষ্ট্র ভালো চলবে। সেই আলোকে পিআর হতে পারে সবচেয়ে ভালো। আজকে যে পদ্ধতি উত্থাপন করা হয়েছে, মধ্যবর্তী পন্থা হিসেবে এটাও অসাধারণ। তবে আমরা এক দিনে সবটা অর্জন করতে পারব না। ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম অপু বলেন, ‘পিআরের ক্ষেত্রে প্রথমে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত জরুরি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের সহযোগীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হবে কিনা? শুরুতে জাতীয় পার্টিসহ ফ্যাসিবাদের সকল দোসরকে নির্বাচনের বাইরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এফপিটিপি এর কোনও অপশন বাংলাদেশে নেই। এক্ষেত্রে এমএমপি একটি ভালো ব্যবস্থা হতে পারে।’
গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহতদের প্রতি শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা হয় এবং বৈঠক শেষে বিশেষ দুআ ও মোনাজাত করা হয়।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন—বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা ইউসুফ আশরাফ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা শরাফত হুসাইন, খেলাফত আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা সুলতান মহিউদ্দিন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য মাওলানা মামুনুর রশীদ, বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা জাহিদুজ্জামান, বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মাদ আব্দুল আজিজ।
সভায় উপস্থিত ছিলেন—বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা তোফাজ্জল হুসাইন মিয়াজী, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা এনামুল হক মুসা, মাওলানা আবু সাইদ নোমান, বায়তুল মাল সম্পাদক মাওলানা ফজলুর রহমান, আইন বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা শরীফ হোসাইন, সহ-প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাওলানা হাসান জুনাইদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য মাওলানা আব্দুস সুবহান, মাওলানা সানাউল্লাহ আমিনী, মাওলানা মুর্শিদুল আলম সিদ্দিক প্রমুখ।



