
প্রিন্ট: ২৮ জুন ২০২৫, ০১:৫৩ পিএম
মেডিক্যালের নামে প্রবাসী শ্রমিকদের ৮০০ কোটি টাকা স্বপনের পেটে

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৫, ০২:৫২ পিএম

রুহুল আমিন স্বপন। ফাইল ছবি
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর নামে গড়ে ওঠা নিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে থাকা আলোচিত ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপনের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তাঁর মালিকানাধীন মীম মেডিক্যাল ও ক্যাথারসিস মেডিক্যালের মাধ্যমে লাখো গমনেচ্ছু শ্রমিকের কাছ থেকে অতিরিক্ত মেডিক্যাল ফি আদায় করা হয়েছে। এ টাকা বিভিন্ন চ্যানেলে বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এখন সমন্বিত তদন্ত, দ্রুত বিচার এবং সংশ্লিষ্টদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের ৩১ মে পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় চার লাখ ৯৪ হাজার কর্মী পাঠানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় বাধ্যতামূলক মেডিক্যাল পরীক্ষার সুযোগ পায় কেবল কিছু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান, যার প্রায় সবই ছিল স্বপনের নিয়ন্ত্রণাধীন। অভিযোগ রয়েছে, গড়ে ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত মেডিক্যাল ফি আদায় করা হয়েছে প্রতিটি কর্মীর কাছ থেকে।
এভাবে ৮০০ কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়, যার বড় অংশই পাচার করা হয়েছে বলে দাবি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। শুধু কর্মী পাঠানো নয়, অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েও মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়নি। এমনকি, অনেক ক্ষেত্রে মেডিক্যাল পরীক্ষা ছাড়াই দেওয়া হয়েছে ‘ফিটনেস সার্টিফিকেট’। এতে বিদেশে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে।
পটুয়াখালীর রাব্বি হোসেনের মতো অনেক ভুক্তভোগী জানান, একাধিকবার মেডিক্যাল করেও মালয়েশিয়া যেতে পারেননি তারা। আবু কাউসার ও তাঁর চাচা চড়াভাবে মেডিক্যাল ফি পরিশোধ করেও ভিসার অপেক্ষায় আছেন। অনেকে দাবি করেছেন, মেডিক্যাল সেন্টারে নাশতার খরচ ও ওষুধের দামও দিতে হয়েছে বাড়তি করে।
তদন্তে উঠে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গেছে, প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ শ্রমিককে মেডিক্যাল টেস্ট করানো হয়েছে, যদিও মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়েছে মাত্র পাঁচ লাখ। এর বেশিরভাগই হয়েছে স্বপনের প্রতিষ্ঠান ও তাঁর সিন্ডিকেটের নির্ধারিত ৪৭টি সেন্টারে। অন্যান্য সেন্টারে পরীক্ষা করলেও কর্মীপ্রতি তিন হাজার টাকা করে ‘কাটমানি’ দিতে হতো স্বপনের অফিসে, না হলে রিপোর্ট বাতিল করে দেওয়া হতো।
রুহুল আমিন স্বপনের বিরুদ্ধে ব্যাংকিং লেনদেন, মোবাইল ফাইন্যান্স এবং হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচারেরও প্রমাণ মিলেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্যমতে, তাঁর বা পরিবারের নামে কমপক্ষে ১২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গত দুই বছরে ৯৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। কর ফাঁকি দিয়ে ব্যবসায়িক আয়ের বড় অংশ রেমিট্যান্স দেখিয়ে সরকারের প্রণোদনাও নিয়েছেন তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) জানিয়েছে, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে ১৩৯ কোটি টাকা এবং ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে ১.৪৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন স্বপন, যার বড় অংশ আয়কর রিটার্নে উল্লেখ নেই।
এই প্রতিবেদনের বিষয়ে রুহুল আমিন স্বপনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বপনের মতো সিন্ডিকেট সদস্যদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার না হলে ভবিষ্যতেও প্রবাসী শ্রমিকরা এমন প্রতারণার শিকার হবেন।