Logo
Logo
×

জাতীয়

জাল সনদে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী এখন পাইলট!

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:০১ পিএম

জাল সনদে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী এখন পাইলট!

ছবি : সংগৃহীত

সাদিয়া আহমেদ পড়ালেখা করেছেন মানবিক বিভাগে। তবে ঢাকা বোর্ডের একটি জাল সনদ ব্যবহার করে নিজেকে বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ দেখিয়ে উড়োজাহাজ চালানোর প্রশিক্ষণ নেন তিনি। সেই জাল সনদেই তিনি ২০১৩ সালে রিজেন্ট এয়ারওয়েজে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে যোগ দেন। অদক্ষতা ও বিপজ্জনকভাবে উড়োজাহাজ চালানোর কারণে ২০১৬ সালে তিনি চাকরিচ্যুত হন। ২০১৭ সালে একই লাইসেন্স ব্যবহার করে তিনি ইউএস বাংলায় যোগ দেন। তবে অদক্ষতার জন্য সেখানেও বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেননি।

সবশেষে, সাদিয়া আহমেদ ২০১৯ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৩৭-এর ফার্স্ট অফিসার হিসেবে যোগ দেন। অভিযোগ ওঠে, তার স্বামী বিমানের ওই সময়ের প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রধান ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদের হস্তক্ষেপেই এখানে নিয়োগ পান। তবে লাইসেন্সিং পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ, অযোগ্যতা ও উড্ডয়ন ঘাটতি থাকায় প্রশ্নবিদ্ধ হয় এ নিয়োগ প্রক্রিয়া। পরে ২০২৩ সালের ৩০ মার্চ তাকে অব্যাহতি দেয় বিমান বাংলাদেশ। এ সময় ঢাকা বোর্ডের জাল সনদের বিষয়টি প্রকাশ হলে ২০২৩ সালের ২২ নভেম্বর বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ তার লাইসেন্স বাতিল করে সাদিয়ার বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা দায়ের করে।

এভাবেই সনদ জালিয়াতি করে পাইলট হওয়ার গল্প শেষ হতে পারত, কিন্তু সাদিয়া সিভিল এভিয়েশনে রিভিউ আবেদন করেন। সেই আবেদনের ভিত্তিতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি, যা সনদ জালিয়াতির আরও আশ্চর্যজনক তথ্য উন্মোচন করে। এবার কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে আরও একটি জাল সনদ নিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করেন সাদিয়া। তবে এই জাল সনদের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

২০০৮ সালে এইচএসসি ভোকেশনাল পরীক্ষায় পাস করার যে সনদ সাদিয়া জমা দেন, তার ভিত্তিতে যুগেরচিন্তা২৪ নবাবগঞ্জের দোহারে জয়পাড়া সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অনুসন্ধান চালায়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, জয়পাড়া সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে সাদিয়া আহমেদ নামে ২০০৬-০৭ সেশনে কোনো ছাত্রী ছিল না।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইট তথ্যসূত্রে জানা যায়, সাদিয়া আহমেদ ২০০৮ সালের এইচএসসি শিক্ষার্থী যার রোল নং ৮০২২৬৫ এবং রেজি নং ৬৯৬৯২৫, সেশন : ২০০৬-০৭। তার ট্রেড/স্পেশালাইজেশন অ্যাগ্রো মেশিনারি। পিতার নাম সালাহ্ উদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম তালাত জামানি মজুমদার।

যুগেরচিন্তা২৪ এর কাছে বিষয়টি জানতে পেরে জয়পাড়া সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে।

তদন্ত কমিটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে, কলেজটির অধ্যক্ষ নুর উদ্দিন আহমদ একটি লিখিত প্রতিবেদন জারি করেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাদিয়া আহমেদ নামে কোনো শিক্ষার্থী ২০০৮ সালে এইচএসসিতে এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছিলেন না। ভর্তি ও ফলাফল রেজিস্টার যাচাইবাছাই করে প্রতীয়মান হয় যে, উল্লিখিত রোল ও রেজিস্ট্রেশনধারী শিক্ষার্থীর নাম সাদিয়া আহমেদ নয় বরং মো. নাসির উদ্দিন।

অধিকতর তদন্তে জানা যায়, মো. নাসির উদ্দিন জয়পাড়া সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২০০৪ সেশনে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। এরপর ২০০৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ ৩ দশমিক ৮২ পেয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে উত্তীর্ণ হন। সেই সময় তার রেজি. নম্বর ছিল ০০৪৫৩৮ এবং রোল নম্বর ছিল ৩০৩৭৭৫। পিতার নাম মো. নূরুল ইসলাম এবং মাতার নাম লাইলি বেগম।

পরবর্তীতে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০০৬-০৭ সেশনে ভর্তি হয়ে ২০০৮ সালে ট্রেড/স্পেশালাইজেশন অ্যাগ্রো মেশিনারি বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। সেখানে তার রোল নম্বর ছিল ৮০২২৬৫ এবং রেজি. নং ৬৯৬৯২৫। ২০০৮ সালে এইচএসসি বোর্ড সমাপনী পরীক্ষায় তিনি রসায়ন বিষয়ে অকৃতকার্য হন।

অথচ, একই রোল এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর সম্বলিত সনদে দেখা যায়, সাদিয়া আহমেদ ৪ দশমিক ৯০ পেয়ে এ প্লাস নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিস্ময় প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সচিব মো. আল মাসুদ করিম বলেন, ‘সার্টিফিকেটের তথ্য জালিয়াতির বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে আমরা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের স্বচ্ছতা ফেরাতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ইতোমধ্যে বুয়েটের একটি ফরেনসিক টিমকে তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ দেয়া হয়েছে। আমাদের হাতে ফরেনসিক রির্পোট এলে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হবে।’

কীভাবে সার্টিফিকেট জালিয়াতি হয়েছে - এমন তথ্যের জবাবে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কেপায়েত উল্লাহ বলেন, ‘বোর্ডের তথ্য সিডি ড্রাইভের মাধ্যমে টেলিটককে দেয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে সেখানে আগের তথ্য পরিবর্তন বা জালিয়াতি হয়েছে। সাবেক সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ ধরনের অপরাধের দায়ে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। বিগত বছরগুলোতে তার হাতে কম্পিউটারের সার্ভারে আপলোড এবং সিডি পাঠানোর দায়িত্ব ছিল। বর্তমানে একই ব্যক্তির হাতে দুটি দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না এবং এই বিষয়গুলো বিশেষভাবে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।’

কয়েকজন কর্মকর্তার মতে, বোর্ডের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী গত এক দশকে অর্থের বিনিময়ে বহু জাল সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন। ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, টেকনোলজি, ফিশারিজসহ বিভিন্ন বিষয়ে ডিপ্লোমা সনদ বিক্রি করা হয়েছে। এসব সনদ ব্যবহার করে অনেকে চাকরি করছেন বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। প্রায় ৩০ হাজার ভুয়া কম্পিউটার শিক্ষা সনদ দিয়ে কয়েক হাজার শিক্ষকও এমপিওভুক্ত হয়েছেন। সনদগুলো বোর্ডের সার্ভারে তথ্য আপলোড করে বৈধতার ছাপ দেয়া হতো, ফলে নকল সনদ শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ত।

Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
Email: [email protected]

অনুসরণ করুন