ড্রামে ২৬ খণ্ড মরদেহ: ত্রিভুজ প্রেমের জেরে ব্যবসায়ী আশরাফুল খুন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৫৪ এএম
রাজধানীতে কাঁচামাল ব্যবসায়ী আশরাফুল হকের ২৬ টুকরো মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে সারাদেশে। গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের গেটের কাছে দুটি নীল রংয়ের ড্রামে পাওয়া যায় তার মরদেহ। নৃশংস এই হত্যার প্রধান আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার বন্ধু জরেজুল ইসলামকে।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, শামীমা আক্তার নামে এক নারীর সঙ্গে একইসঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন বন্ধু আশরাফুল ও জরেজুল। দুজনের ত্রিভুজ প্রেম থেকেই দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, যা শেষ পর্যন্ত আশরাফুলের হত্যায় রূপ নেয়।
হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে উঠে এসেছে, দক্ষিণ ধনিয়ার একটি ভাড়া বাসায় প্রথমে বালিশচাপা দিয়ে আশরাফুলকে অচেতন করেন জরেজুল। এরপর মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। মরদেহ দুই দিন বাসায় রেখে পরে ২৬ টুকরো করেন জরেজুল ও শামীমা। দুটি ড্রামে ভরে সেগুলো ঈদগাহ মাঠের কাছে ফেলে পালিয়ে যান তারা।
স্থানীয়দের চোখে পড়ে ড্রাম দুটি। তারা পুলিশকে খবর দিলে ঘটনাস্থলে এসে ডিবি ও সিআইডি খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করে। ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে শনাক্ত হয় লাশটি আশরাফুল হকের।
পালানোর চেষ্টা ও গ্রেপ্তার
শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) রাত ১০টার দিকে কুমিল্লা থেকে জরেজুলকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। অন্যদিকে লাকসাম থেকে র্যাব–৩ গ্রেপ্তার করে শামীমা আক্তারকে। তিন বছর আগে ফেসবুক ও মেসেঞ্জারের মাধ্যমে জরেজ ও শামীমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জরেজুল মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে শামীমার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ান। পরে একই সম্পর্কে যুক্ত হন আশরাফুলও, যা রূপ নেয় ভয়াবহ সংঘর্ষে।
কীভাবে ফেটে যায় বন্ধুত্ব
রংপুরের একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। জরেজুলের মাধ্যমে শামীমার সঙ্গে পরিচয় হয় আশরাফুলের। পরে তিনজনের সম্পর্ক জটিল আকার নিলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন জরেজ। হত্যার দিন মোবাইল ফেরত দিতে বাসায় ফিরে দেখেন, শামীমা ও আশরাফুল একসঙ্গে ঘুমিয়ে আছে। এরপর রাতভর অপেক্ষা করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেন তিনি।
ময়নাতদন্ত রিপোর্টের ভয়াবহতা
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. দীপিকা রায় ময়নাতদন্ত শেষে জানান, গলা থেকে নিচ পর্যন্ত ২৫ টুকরোসহ মোট ২৬ খণ্ডে লাশ পাওয়া গেছে। শরীরের বহু অংশ মিল পাওয়া যায়নি। পরে লাশ হস্তান্তর করা হয় পরিবারের কাছে।
পরিবারের অভিযোগ ও মামলা
আশরাফুলের বোন আনজিনা বেগম শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করেন। তিনি অভিযোগ করেন, আশরাফুলকে ব্যবসায়িক কাজে ঢাকায় এনে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে জরেজ ও তার সহযোগীরা। মরদেহ গোপন করতে ২টি নীল ড্রামে ভরে ফেলে যায় তারা।
স্ত্রী লাকী বেগম বলেন, বিদেশে যাওয়ার জন্য ১০ লাখ টাকা ধার চেয়েছিল জরেজ। সেই টাকার লোভেই আমার স্বামীকে ঢাকায় নিয়ে এসে খুন করেছে। তার কঠোর শাস্তি চাই।
পুলিশের বক্তব্য
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ডিবি-দক্ষিণ) নাসিরুল ইসলাম জানান, ত্রিভুজ প্রেমের জেরে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মূল আসামি জরেজুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং আইনগত প্রক্রিয়া চলছে।
ব্যবসায়ী আশরাফুল রংপুরের বদরগঞ্জের নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। হিলি স্থলবন্দর থেকে কাঁচামাল কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতেন তিনি। বন্ধু হিসেবে জরেজই তার বেশিরভাগ ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশ দেখাশোনা করতেন।
ত্রিভুজ প্রেম, লোভ ও বিশ্বাসঘাতকতার জেরে শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিতে হলো এই ব্যবসায়ীকে।



