গণভোট ইস্যুতে উত্তাপ বাড়ছে, বিরোধে বিএনপি-জামায়াত, চাপে ইসি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৪৪ পিএম
গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে নাকি আলাদা দিনে হবে—এই প্রশ্নেই বর্তমানে প্রবল চাপের মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনৈতিক চাপ ও প্রশাসনিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও কমিশনের মূল মনোযোগ এখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, চাপ আছে, কিন্তু মনোযোগ হারাইনি। আমাদের লক্ষ্য একটাই—সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন।
ইসির বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট আয়োজনের লক্ষ্যে প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশ অনুযায়ী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরিকল্পনা করছে কমিশন। ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।
বর্তমান রাজনৈতিক বিতর্কের মূল কেন্দ্র গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে নাকি আলাদা সময়ে হবে, তা নিয়ে। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ আটটি দল নভেম্বরে গণভোট আয়োজনের দাবি তুলেছে, অন্যদিকে বিএনপি চাইছে—গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে করা হোক। জামায়াতসহ আট দলের দাবি, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, দুর্নীতির বিচার ও ১৪ দল নিষিদ্ধ করা। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, একসঙ্গে ভোট হলে ব্যয় কমবে ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বাড়বে।
তবে এ বিষয়ে সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও আসেনি। ৩১ অক্টোবর সচিব পর্যায়ের বৈঠকে ইসি জানিয়েছে, দুটি ভোট একসঙ্গে হলে কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়াতে হবে, আলাদা হলে ব্যয় অনেক বেশি হবে। কমিশন ইতোমধ্যেই প্রশাসনকে হেলিপ্যাড সংস্কার, ভোটকেন্দ্র মেরামত, সিসি ক্যামেরা সচল রাখা ও মেডিকেল টিম প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছে।
মাঠপর্যায়ের তদন্ত ও পুনঃতদন্তের কারণে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলছে। ইসি ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ও জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায়, তবে আপত্তির কারণে আবারও পর্যালোচনা চলছে। আরও ১০টি দলের বিষয়ে তদন্ত চলছে। একই সঙ্গে পর্যবেক্ষক সংস্থার তালিকা নিয়েও যাচাই-বাছাই চলছে, কারণ প্রকাশিত ৭৩টির অনেকগুলোরই কার্যকর অফিস নেই।
এদিকে আদালতের রায়ে নিবন্ধন ফিরে পেয়েছে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)। নতুন দল এনসিপি তাদের প্রতীক নিয়ে বিতর্কে জড়ালেও পরে ইসির তালিকায় যুক্ত ‘শাপলা কলি’ প্রতীক নিতে সম্মত হয়েছে।
সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এবার জোটবদ্ধ দলগুলো নিজ নিজ প্রতীকে ভোট করবে। বিএনপি ও তার শরিকরা এই বিধানের বিরোধিতা করছে, তবে জামায়াত এর পক্ষে। বিএনপির যুক্তি—একই প্রতীকে ভোট দিলে ঐক্য বজায় থাকে, আর জামায়াত বলছে, বিধানটি বাতিল হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ভঙ্গ হবে। ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, বিষয়টি এখন আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে।
প্রায় সাড়ে ১০ লাখ কর্মকর্তা জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও অন্যান্য দল দাবি করছে, অতীতে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের বাদ দিতে হবে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে জামায়াত বলছে, পেশার ভিত্তিতে কাউকে বাদ দেওয়া বৈষম্যমূলক হবে।
ইসি আশঙ্কা করছে, নির্বাচনের আগে ‘মব সন্ত্রাস’ ও অস্ত্র ব্যবহার বেড়ে যেতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ভোটের আগে ও পরে আট দিন মাঠে থাকবে সাড়ে আট লাখ সদস্য। সেনাবাহিনী ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে কাজ করবে। সিইসি জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কমিশনের অধীনে থাকবে, কোনো দলকে সুবিধা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।
এছাড়া প্রতিটি উপজেলায় মেডিকেল টিম, হেলিপ্যাড ও উদ্ধার ইউনিট প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। গুজব প্রতিরোধে তৈরি হচ্ছে এআই-নির্ভর মনিটরিং সেল।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন প্রস্তুতি বৈঠকে ইসিকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ ও ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণার নির্দেশ দিয়েছেন। ইসি জানায়, ঘোষিত ২৪ দফা রোডম্যাপের অধিকাংশই সম্পন্ন হয়েছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, সরঞ্জাম ক্রয়, প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি শেষ হয়েছে। তবে দল নিবন্ধন, পর্যবেক্ষক যাচাই এবং প্রবাসী ভোটার অন্তর্ভুক্তিতে কিছুটা ধীরগতি রয়েছে।
প্রবাসী ভোটার অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে ৫০ লাখের লক্ষ্য থাকলেও এখন পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার ভোটার। ১৬ নভেম্বর চালু হতে যাচ্ছে ডিজিটাল পোস্টাল ব্যালট অ্যাপ, যা প্রবাসীদের জন্য নতুন ভোট ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে।



