বিভুরঞ্জন সরকার খোলা চিঠিতে যে বার্তা দিয়ে গেলেন
মনজুরুল আলম মুকুল
প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০৭:০০ পিএম
বর্ষীয়ান কলামিস্ট ও সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর তাঁর লাশ মুন্সিগঞ্জের মেঘনা নদী থেকে উদ্ধার হয়। হয়ত পুলিশ তদন্ত করে বের করবে কী কারণে উনার মৃত্যু হয়েছিল।
তবে মারা যাওয়ার আগে এই বর্ষীয়ান কলামিস্ট ও সাংবাদিক তার খোলা চিঠিতে দেশের সাংবাদিকতা পেশার দৈন্যদশা, রাষ্ট্র ও সমাজের যেসব বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করেছেন তা স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্য জনক।
বিভুরঞ্জন সরকার প্রায় পাঁচ দশক ধরে দুহাত ভরে লিখে ছিলেন। দেশের নানা পরিবর্তন, আন্দোলন, গণআন্দোলন, রাজনৈতিক উত্থান-পতন ও বাস্তব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন।
বলা যেতে পারে সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার সারা বাংলাদেশের সাংবাদিক সামজের প্রতীক, গুটি কয়েক নামধারী ছাড়া প্রায় সবার অবস্থা তার মত।
দেশের শিক্ষিত পেশাজীবীদের একটির অংশের কাছে কতটা সুখী জানতে চাইলে বিষয়টি কোনমতে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের কোন উপায় থাকেনা। এদের মধ্যে অন্যত্তম হল সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীরা। নিজেদের আয় রোজগারের সাথে মিল রেখে সমাজ-সংসার রক্ষা করতে যেয়ে তাদের জীবনে প্রতিদিন অনেক কষ্টের গল্প তৈরি হয়।
সাংবাদিকরা সমাজের বিভিন্ন অনিয়ম ও অসঙ্গতি তুলে ধরে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করে। অথচ পেশা বা চাকরি, সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের অবস্থা একেবারে তলানিতে। নিজেদের কথা নিজেরাই বলতে পারেনা, আবার অন্যরাও বলে না। ফলে তাদের জীবনের গল্পগুলো সবসময় সবার অগোচরে থেকে যায়। প্রায় প্রত্যেক সাংবাদিকের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থা।
সূত্র অনুযায়ী সারাদেশে নিবন্ধিত পত্রিকার (প্রিন্ট মিডিয়া) সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। জাতীয় ও স্থানীয় মিলে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজারের কাছাকাছি দৈনিক পত্রিকা আছে। শুধু ঢাকা হতে প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকার সংখ্যা প্রায় বার শত । বর্তমানে দেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় কয়েকটি টিভি চ্যানেল সহ প্রায় চার ডজন বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল আছে। পাশাপাশি রয়েছে বেশকিছু রেডিও।
অনলাইন মিডিয়ার সম্ভবনার কারণে দেশে ব্যাঙের ছাতার মত অসংখ্য অনলাইন নিউজ পোর্টালের উদয় হয়েছে। অনলাইন মিডিয়ার সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন এর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজারের বেশি। সরকার রেজিস্ট্রেশনের নিয়ম চালু করলেও রেজিস্ট্রেশনের বাইরের সব গুলো এখনও বন্ধ করতে পারিনি।
এই পরিসংখ্যান গুলো থেকে ধারণা করা যায় মিডিয়া জগতে কি চলছে। কে বা কারা রেজিস্ট্রেশন, নিবন্ধন ও অনুমোদন নিচ্ছে বা নেওয়ার পর কি করছে তা জানার বা দেখার প্রয়োজনীয়তা যেন কেউ অনুভব করছেনা। এর ফলে প্রকৃত সংবাদ কর্মীরা চাপা পড়ছে।
সামাজিক পেক্ষাপট, অব্যাহত অনিয়ম ও অনেকের সুযোগ সন্ধানী নীতির কারণে সাংবাদিকের হাহাকার বেড়েই চলেছে। এই হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যে সাংবাদিকতা পেশার উন্নয়নের জন্য কেউ কোন পদক্ষেপ নিলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
সংবাদপত্রের সাংবাদিক ও কর্মচারীদের বেতন হওয়ার কথা সরকার ঘোষিত মজুরি বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী এবং সেই অনুযায়ী সরকারি বিজ্ঞাপনের মূল্যও নির্ধারণ হয়। বর্তমানে চলছে নবম ওয়েজ বোর্ড। সেই অনুযায়ী সংবাদপত্রের সাংবাদিক ও কর্মচারীরা বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেলে কিছুটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করার কথা। কিন্তু ওয়েজ বোর্ডের বাস্তবায়ন হয় খুবই কম। এর মধ্যে পুনাঙ্গ ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করে হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা, আর কয়েকটি আংশিক বাস্তবায়ন করে। অধিকাংশই এর কিছুই মানেনা। এমন অনেক পত্রিকা আছে যেখানে সাংবাদিক নিয়োগ দিয়ে বলা হয় “তোমার বেতন, তুমি সংগ্রহ করো।”
অনেকে পত্রিকার ডিক্লারেশন নেয়ার সময় আইন অনুযায়ী সকল বেতন-ভাতা ও পাওনাদি দেওয়ার অঙ্গীকার করে। ভাল বেতন ও সুযোগসুবিধার লোভ দেখিয়ে অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য ডিএফপি-র রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার পর তাদের চেহারা পাল্টে যায়। ছাঁটাই শুরু হয়, অনেকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়। বাজারে বেকার সাংবাদিকদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা আবার নতুন করে চাকরি খোঁজা শুরু করে, অনেকে এই সুযোগ গ্রহণ করে। এক সময় সংসার নামক ঘানির কারণে তাদেরকে লজ্জাজনক ও অপমানজনক বেতনে পত্রিকায় চাকরি নিতে হয়। সাংবাদিক সমাজ যেন এই চক্রের মধ্যে আটকা পড়ে আছে।
ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়া ওয়েজ বোর্ডের বাইরে থাকায় দরকষাকষির সুযোগ কম থাকে। অনেক প্রতিষ্ঠান এমনভাবে বেতন ধরে যেটা খুবই বিস্মিত ও হতবাক করার মত।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অব্যাহত উন্নিতির কারণে বর্তমানে বিশ্বে অনলাইন মিডিয়ার জয়জয়াকার। বড় বড় প্রত্রিকার সার্কুলেশন কমতে কমতে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে অনলাইন মিডিয়ার পাঠক হুহু করে বেড়ে চলেছে। কিন্তু দেশের বিজ্ঞাপণ ব্যবস্থার পুরোটাই পত্রিকাকেন্দ্রিক হওয়াতে অনলাইন মিডিয়া গুলো তেমন সুবিধা পাচ্ছেনা। যার পরোক্ষ প্রভাব সাংবাদিক সমাজের উপরও পড়ছে।
বাজারে চালু অনলাইন নিউজ পোর্টাল গুলোর মধ্যে হাতেগোনা কিছু সাংবাদিকের নিয়মত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন, বাকি গুলোর অবস্থা খুবই খারাপ।
মফস্বলদের সাংবাদিকদের অবস্থা আরও খারাপ। অধিকাংশ মফস্বল সাংবাদিকদের আইডি কার্ড ধরিয়ে দেওয়া হয়। খুব সামান্য সংখ্যক সাংবাদিকদের সামান্য পরিমাণে টাকা দেওয়া হয় যেটা তাদের যাতায়াত, ইন্টারনেট ও মোবাইলের পিছুনে খরচ হয়ে যায়।
একজন দুঃখ করে বলেছিলেন, অনেকের ধারনা আমাদের কোন খরচ নাই, কিন্তু সমাজের আর দশজন মানুষের মত আমাদেরও যে পরিবার পরিজন আছে, বাজারে যেতে হয়, সেটা কেউ বুঝতে চায়না। ২৪ ঘন্টা সময় দিয়ে এত কম টাকায় বাংলাদেশে আর কোন পেশার মানুষ কাজ করে না।
সারাজীবন চাকরি করার পর অধিকাংশ সাংবাদিককে প্রায় খালি হাতে বাড়ি চলে যেতে হয়। কারণ মালিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ডও চালু করেন না। নেই কোনও পেনশন সুবিধা।
আর্থিক দৈন্যদশার পাশাপাশি বর্ষীয়ান কলামিস্ট ও সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের খোলা চিঠিতে ফুটে উঠেছে সমাজের প্রভাবশালী ও শাসক শ্রেণীর চাপ। তাই তিনি লিখেছেন, “সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়।” সত্যকে তারা ভয় পায় তাই সাংবাদিকের টুটি চেপে ধরতে চায়। তাই অনেক সময় সত্য প্রকাশ করতে সাংবাদিকদের কপালে ঘাম ঝরে। নিষ্ঠুর আঘতের শিকার হতে হয়। এমন পরিবেশ বিদ্যমান শুধু নিজের জীবনের উপর হুমকি থাকেনা, স্ত্রী-সন্তানদের উপরে থাকে বিপদের ছায়া।
ভোটার থাকতে বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া, পাতানো নির্বাচন, রাতের ভোট, ভোট ডাকাতি, ভোট জালিয়াতি, ভোট ম্যাকানিজম অনেক কিছু দেশে ঘটে কিন্তু সত্য লেখা যায় না। অবৈধ ধনসম্পদ ও অর্থপাচারের খবর, দুর্নীতি ও অপরাধের খবর প্রকাশে সাংবাদিকদের অনেক রোষানলে পড়তে হয়।
তিনি লিখেছেন, “শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সৎ সাংবাদিকতা করা কেবল দুরূহ নয়, জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণও বটে। অনেক তারকা সাংবাদিক এসে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করার যখন চেষ্টা করে, দিন শেষে আর্থিক দৈন্যের শিকার হন”।
বিভুরঞ্জন সরকারের খোলা চিঠিতে এটাও ফুটে উঠেছে, সব সাংবাদিক যে আর্থিক টানাটানির মধ্যে থাকে এমনটি নয়। অনেকে রাজার হালে থাকেন। অনেকে সাংবাদিক পরিচয়ে রাজধানী ঢাকা শহরে প্লট, ফ্লাট ও অনেক রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। তিনি এটা বলতে চেয়েছেন, সৎ ও আদর্শবান মানুষের স্থান নেই, মূল্য নেই। দুর্নীতিবাজ, অসৎ ও লুটেরাদের লালন করে এই সমাজ।
রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর হয়ে লেজুরবৃত্তি সাংবাদিকতা এখন মহামারি আকার ধারন করছে। কিছু নামধারী সাংবাদিক যে ভাষায় লেখে বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় অনেক সময় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ছাড়িয়ে যায়। তারাই সুযোগসুবিধা নিয়ে থাকে এবং অনেকে অল্পসময়ে বিত্তবৈভবের মালিক বনে যায়।
বিভুরঞ্জন সরকার লিখেছেন, “আজকের সময়ে সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ অন্যরূপ। অনেকেই সুবিধা, স্বার্থ, সামাজিক মর্যাদা বা আর্থিক স্বার্থের জন্য সত্যকে আড়াল করে লেখেন”।
তিনি গণমাধ্যমে কর্মরতদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ও পদোন্নতি নিয়ে অনিয়ম ও বৈষম্যের কথা তুলে ধরেছেন। আজকাল লিখলে অনেক পত্রিকা ও প্রতিষ্ঠান সম্মানিও দিতে চায়না এবং বিষয়টি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। গণমাধ্যমগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে এই ধরনের অনিয়ম ও বৈষম্যে দূর করা বিশেষ প্রয়োজন।
বিভুরঞ্জন সরকার ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন, অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি বা মুক্তিযুদ্ধে কোনো অবদান ছিলনা। তারা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বাগিয়ে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, নিচ্ছেন।
সরকার যায়, সরকার আসে। অনেকে নিজেদেরকে সাংবাদিকবান্ধব সরকার হিসাবে ঘোষণা করেন, কল্যাণ তহবিলের মাধ্যমে অনুষ্ঠান করে দুস্থদের টাকা দেন কিন্তু প্রকৃত অর্থে সাংবাদিকতা পেশার উন্নয়নে কোন ভূমিকা থাকেনা।
লেজুড়বৃত্তিক সাংবাদিকতা কারণে রাষ্ট্র, জনগণ ও জাতীয় স্বার্থ কোন সময় সত্যিকার অর্থে অগ্রাধিকার পায়না। তথ্য গোপন, বিকৃত বা একপেশে ভাবে উপস্থাপন করার কারণে শুধু জনগণ নয় এক সময় সবাই প্রকৃত চিত্র থেকে বঞ্ছিত হয়। এর ফলে সমাজ, গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতার চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দেশে সুস্থ গণতন্ত্র চর্চা ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য সুস্থ সাংবাদিকতার কোন বিকল্প নেই। সাংবাদিকতা পেশাকে ধ্বংস ও লেজুড়বৃত্তিক সাংবাদিকতার পৃষ্টপোষকতার মাধ্যমে গণতন্ত্র চর্চা করলে তা কখনও টেকসই হয় না, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিভুদা জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন, আমাদেরকে সতর্ক করে গেলেন। সাংবাদিকতা পেশার হ-য-ব-র-ল অবস্থা সংশোধনের জন্য এখনি পদক্ষেপ নিয়ে সঠিক পথে পরিচালিত হওয়া বিশেষ প্রয়োজন তা না হলে পুরো জাতিকে হয়ত একদিন আরও বেশি বড় মূল্য দিতে হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী



