
প্রিন্ট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:৫৭ এএম
হলফনামায় হাসিনার ‘তথ্য গোপনে’ করার কিছু নেই : দুদককে ইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৫, ১২:১৫ পিএম

ছবি - সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
নবম সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনা যে হলফনামা দাখিল করেছিলেন, তাতে ‘তথ্য গোপনের’ বিষয়ে কিছু করার নেই বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। দুদককে চিঠি দিয়ে এ কথা জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসি সচিব আখতার আহমেদ।
তিনি বলেন, “আমাদের রিপ্লাই জানিয়ে দিয়েছি। দুদককে চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। “আমরা বলেছি, আরপিওর বিধানে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। আরপিও’তে এ ধরনের কোনো প্রভিশন নেই জানিয়ে দিয়েছি।” হলফনামায় ‘সম্পদের তথ্য গোপনের’ অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে গত ২২ মে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেয় দুদক।
এতে বলা হয়, ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইসিতে দেওয়া হলফনামায় নিজের সম্পদের বিষয়ে অসত্য তথ্য দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয় চিঠিতে।
ইসি কেন ব্যবস্থা নিতে পারেনি
দুদকের চিঠিতে বলা হয়েছে, দুদকে শেখ হাসিনার দাখিল করা সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে দেখা যায়, তিনি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে হলফনামায় ৬ দশমিক ৫০ একর কৃষিজমি এবং তার দাম ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দেখিয়েছেন।
কিন্তু দুদক যাচাই করে দেখেছে, শেখ হাসিনার নামে ২৮ দশমিক ৪১১ একর কৃষিজমি রয়েছে। যার মধ্যে কেনা জমির মোট দাম ৩৩ লাখ ৬৬ হাজার ১০ টাকা। এ হিসাবে তিনি ২১ দশমিক ৯১ একর জমির তথ্য গোপন করেছেন এবং ক্রয়মূল্যও প্রকৃত দামের চেয়ে ৩১ লাখ ৯১ হাজার ১০ টাকা কম দেখিয়েছেন, যা হলফনামায় ‘অসত্য তথ্য দেওয়ার শামিল’।
একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, “হলফনামায় অসত্য তথ্য দেওয়ার অভিযোগ এলে দুটি বিষয় দেখতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১২ অনুচ্ছেদে প্রার্থীর যোগ্য-অযোগ্যতার বিষয়টি রয়েছে। হলফনামার এমন কোনো তথ্য অসত্য দিলেন প্রার্থী, যা তার প্রার্থী বা নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্যতা- তা হলে নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।” তিনি বলেন, “যেমন ঋণখেলাপের বিষয়টি অযোগ্যতার মধ্যে পড়ে; হলফনামায় এ ধরনের বিষয়ে অসত্য তথ্য থাকলে ইসির করার কিছু থাকে। “কিন্তু সম্পদের তথ্যে গড়মিল হলে বা অসত্য তথ্য দিয়েছে অভিযোগ আনলে এ সংক্রান্ত বিষয়টি অযোগ্যতার মধ্যে পড়ে না। সেক্ষেত্রে ইসির করার কিছু থাকে না বিদ্যমান আরপিও’তে। সেক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে অভিযোগ আসে, সে বিষয়ে স্ব স্ব সংস্থার প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার থাকে।”
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এবার একগুচ্ছ আইনি সংস্কার আসছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এমন বিধানের সুপারিশ করেছে, যাতে হলফনামার অসত্য তথ্যের কারণে ভোটের পরেও ব্যবস্থা নেওয়ার এবং নির্বাচন বাতিলের কথা বলা হচ্ছে।
সার্বিক সুপারিশ পর্যালোচনা করে আরপিওতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে নির্বাচন কমিশন তা পাঠাবে আইন মন্ত্রণালয়ে। সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পেলে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হতে পারে।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের জন্য এখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে নির্বাচন কমিশন।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশই ইসির বিবেচনায় রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত কোন কোন সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়, তার ভিত্তিতে আরপিও চূড়ান্ত করা হবে। আর সেজন্য চলতি মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করবে নির্বাচন কমিশন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে, তার বাস্তবায়ন নিয়ে গত ৮ জুলাই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে বৈঠক হয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার আরপিও সংশোধনের সুপারিশসহ একগুচ্ছ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক হয়েছে। সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা আরপিও নিয়ে একাধিক সুপারিশ আরও পর্যালোচনা করে তা চূড়ান্ত করবেন।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ শনিবার বলেন, আরপিও নিয়ে কিমিশনে পর্যালোচনা চলছে। “সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যায়, সবকিছু আমরা রাখতে রাজি আছি। ঐকমত্য কমিশনের যেরকম হলে ভালো হয়, তাদের মতামত প্রাধান্য দিচ্ছি আমরা। ইতোমধ্যে ‘না’ ভোট ফেরানো এবং ‘না’ ভোটের সংখ্যা বেশি হলে নতুন নির্বাচন আয়োজন, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ কটি আসনে মনোনয়নপত্র নিতে পারবে, প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা ও হলফনামার মতন বিষয়ে দলগুলোর ঐকমত্য রয়েছে।
ইসি আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ দিয়েছে, তাতে জনমতের প্রতিফলন থাকা দরকার এবং ঐকমত্যের বিষয়টি ইসি বিবেচনায় নিচ্ছে। ভোটের দিন ছাড়াও নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে বল প্রয়োগ, চাপ সৃষ্টি, অপকর্মের প্রমাণ পেলে কেবল কেন্দ্র নয়, পুরো নির্বাচনি এলাকার ভোট কার্যক্রম বন্ধের ক্ষমতা ইসির হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ আছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী বলেন, “আরপিও সংস্কারের মাধ্যমে ভোটের যেকোনো পর্যায়ে নির্বাচনি আসনের ভোট বন্ধের ক্ষমতা ফিরে পেলে ইসির ক্ষমতা আরও দৃশ্যমান হবে। সার্বিক সংস্কার সুপারিশই করা হয়েছে- নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে; এখন তার বাস্তবায়ন হওয়া দরকার।”
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ‘না’ ভোট ফেরানোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে নির্বাচন বিশ্লেষক ও সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেছেন, ২০০৮ সালে যে ‘না’ ভোট চালু ছিল তা অর্থহীন। আগের নিয়মে ভোট বাতিলের বিধান ছিল না।
সংস্কার : আরপিও, নির্বাচন কর্মকর্তা আইন সংশোধনসহ এক গুচ্ছ সুপারিশ নিয়ে বৈঠকে ইসি
“আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, ৪০% ভোট না হলে সেখানে আবার নির্বাচন হবে। অনিয়মের জন্য পুরো আসনের ভোট বন্ধের ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবও আমাদের ছিল। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে ১১৭টির মতো ছোটখাটোসহ সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু অনেকগুলো ইসির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য করা হয়েছে।”
আলোচনায় কয়েকটি সুপারিশ
• আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার বিদ্যমান সংজ্ঞায় পুলিশ বাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান, আনসার বাহিনী, ব্যাটালিয়ান আনসার, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, বিএনসিসির নাম রয়েছে। এখন সশস্ত্রবাহিনী বা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগের নাম যুক্তের সুপারিশ আছে।
• রিটার্নিং অফিসারের কাছে সরাসরি মনোনয়নপত্র জমার পাশাপাশি অনলাইনে জমার ব্যবস্থা।
• সংসদে প্রার্থী হতে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রস্তাব। এখন প্রার্থী হতে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না, স্বশিক্ষত ব্যক্তিও ভোটে প্রার্থী হতে পারেন। স্থানীয় সরকারে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রসঙ্গ আসায় তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
• একজনের সর্বোচ্চ দুইটি আসনে নির্বাচন করার প্রস্তাব আলোচনায় রয়েছে। অবশ্য সংস্কার কমিশন কেবল একটি আসনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব রেখেছে। বর্তমানে তিন আসনে ভোট করার সুযোগ রয়েছে।
• প্রার্থীকে অন্তত ‘না’ ভোটের সঙ্গে লড়াইয়ের সুপারিশ করা রয়েছে। কোনো আসনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর একক প্রার্থী থাকলে তাকে না ভোটের সঙ্গে লড়তে হবে। আবার কোনো আসনে না ভোট সবার চেয়ে বেশি পড়লে আবার নির্বাচন হতে হবে।
• ইসির তত্ত্বাবধানে প্রার্থীদের প্রচারের ব্যবস্থা। খসড়া আচরণবিধিতে এটা যুক্ত করা হয়েছে।
• প্রবাসীদের জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা সূচক পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থা বিবেচনায় রয়েছে। এক্ষেত্রে ভোটারকে অনলাইন নিবন্ধনের মাধ্যমে আগ্রহের কথা জানাতে হবে।
• ভোটের প্রচারে বিলবোর্ড সংযোজন করা। নতুন আচরণবিধিতে বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।
ঐকমত্যের জন্য অপেক্ষা
ভোটকে সামনে রেখে নির্বাচনি আইন, বিধি, প্রবিধি ও নীতিমালা প্রণয়ন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন সম্পর্কিত কার্যাবলি সম্পাদন এবং ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটির তদারকির দায়িত্ব রয়েছে নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ।
তিনি বলেন, সংশোধিত আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করা হবে। তবে প্রার্থীদের প্রচারণা ইসি করে দেওয়ার প্রস্তাবের সঙ্গে অর্থসংস্থানের বিষয় রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের যে সংলাপ চলছে, তাতে ‘না’ ভোটের বিষয়টি এখনও আলোচনা হয়নি। এক্ষেত্রে ঐকমত্য হলে তা বিবেচনায় নেবে ইসি।
পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা চায় ইসি
ইসি মাছউদ বলেন, ভোটে অনিয়ম হলে আইনসাপেক্ষে পুরো আসনের কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ রয়েছে। এক্ষেত্রে ভোটের দিনের পরিবর্তে ‘নির্বাচন’ শব্দটি প্রতিস্থাপনের বিষয়টি হবে। তাতে আগের মতো ক্ষমতা পাবে ইসি।
তিনি বলেন, হলফনামার মিথ্যা তথ্য নিয়ে দুই ধরনের বিষয় রয়েছে। ঋণখেলাপি হলে তা যোগ্যতা-অযোগ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর সম্পদের তথ্যে গড়মিল থাকলে তা নিয়ে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা হবে।
আরপিওর সুপারিশ নিয়ে নির্বাচন কমিশন ফের কবে নাগাদ বসবে তা এখনও ঠিক হয়নি। তবে নিজেদের পর্যালোচনার পাশাপাশি ঐকমত্য কমিশনের দিকে তাকিয়ে আছে ইসি।
ইসি আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, “আমরা এখন অপেক্ষা করছি, ঐক্যমতের ভিত্তিতে যেসব বিষয় আসবে, সেগুলো এখানে ইনকরপোরেট করব। এজন্যে টাইমও দিয়েছি। আরেকটু দেখে চূড়ান্ত করব।”
জুলাইয়ের মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত হলে ইসির জন্য সুবিধা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।