Logo
Logo
×

অর্থনীতি

যমুনা ব্যাংকের এমডির খুটির জোড় কোথায়

Icon

স্টাফ রিপোরর্টার :

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৫, ০৭:৩৮ পিএম

যমুনা ব্যাংকের এমডির খুটির জোড় কোথায়

ছবি- সংগৃহীত

ফ্যাসিস্ট মন্ত্রীপূত্রদের নয়নের মনি হয়েও এখনো টিকে আছে যমুনা ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর  হিসেবে। প্রশ্ন উঠেছে বর্তমানে খুটির জোড় কোথায়? যমুনা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মো: সাইদুল ইসলাম ছিলেন সাবেক এলজিইডি মন্ত্রী মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের ছেলে। আরেক পরিচালক সাবেক পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীরের ছেলে গাজী গোলাম আশরিয়া। মন্ত্রী পুত্রদের একচ্ছত্র দাপট ছিল যমুনা ব্যাংকে। 

তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তির শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণী থাকলে তিনি অযোগ্য বিবেচিত হবেন। যমুনা ব্যাংকের বর্তমান এমডি মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ শিক্ষাজীবনে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণীপ্রাপ্ত। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে মন্ত্রী পুত্ররা তাকে নতুন করে আরো পাঁচ বছরের জন্য এমডি হিসেবে পুনর্নিয়োগ দেয়। আর তারই পুরস্কার হিসেবে তিনি ব্যাংকে আইটিসামগ্রী সরবরাহের নামে মন্ত্রী পুত্রদের প্রায় ৭৫ কোটি টাকা লুটপাটের সুযোগ করে দেন। এসব অনিয়মের বিষয়ে দুদকে তদন্ত চলমান রয়েছে । 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, তাজুল ইসলামের ছেলে ও যমুনা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মো: সাইদুল ইসলাম ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে বোর্ড মিটিংয়ে প্রভাব খাটিয়ে ১৫ কোটি টাকার আইটির হার্ডওয়্যার ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি ৮০-৯০ কোটি টাকায় ক্রয় দেখিয়ে সেই টাকা আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া ব্যাংকের বিভিন্ন খাতে শত কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করে বর্তমানে বিদেশে পলাতক রয়েছেন। তিনি বাবার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বিশেষ করে ২০২৩ সালের ১৩ আগস্টের বোর্ড মিটিং এ আইটি বিভাগের ১৫ কোটি টাকা মূল্যের হার্ডওয়ার সামগ্রী ৮০-৯০ কোটি টাকায় ক্রয়ের জন্য জোরপূর্বক পাশ করিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ওই বোর্ড মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেন সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের ছেলে মো: সাইদুল ইসলাম। অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে ওই সভায় আইটিসামগ্রী পাস করানোর সাথে যমুনা ব্যাংকের পরিচালক রেদোয়ান কবির আনসারী, পরিচালক রবিন রাজন সাখাওয়াত এবং আইটি বিভাগের প্রধান জাহিদ জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

আইটিসামগ্রী ক্রয়ের অভিযোগের ব্যাপারে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক স্বাক্ষরিত চিঠি দুর্নীতি দমন কমিশনে গেলে পুনরায় এটি আলোচনায় আসে। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের মহাপরিচালককে (মানি লন্ডারিং) কমিশনের ব্যাংক শাখা হতে অনুসন্ধান পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেছে। বর্তমানে সাবেক মন্ত্রীপুত্র সাইদুল ইসলাম বিদেশে পালিয়ে গেছেন বলে জানা যায়।

এ দিকে যমুনা ব্যাংকের এমডি নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণী থাকলে তিনি কোনো ব্যাংকের এমডি হতে পারবেন না। যমুনা ব্যাংকের বর্তমান এমডি মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ শিক্ষাজীবনে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণীপ্রাপ্ত। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে তাকে আরো পাঁচ বছরের জন্য এমডি হিসেবে পুনর্নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের এক তদন্তে এমন অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। এ ছাড়া তার বেতন-ভাতা বাবদ পরিচালিত ব্যাংক হিসেবেও আর্থিক লেনদেনে অনিয়ম পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব অনিয়মের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে বলা হলেও কোনো প্রকার ব্যবস্থা নেয়নি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।

জানা যায়, মির্জা ইলিয়াছ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৮৫ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি প্রাইম ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে যমুনা ব্যাংকে এসএভিপি হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০১৩ সালে একই ব্যাংকে ডিএমডি এবং ২০১৬ সালে এএমডি হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর ব্যাংকটির এমডি ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৯ সালে যখন তাকে নিয়োগ দেয়া হয়, সেই সময়েও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম না মেনেই নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কারণ ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের এমডি নিয়োগসংক্রান্ত এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়েই তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণী গ্রহণযোগ্য হবে না। সম্প্রতি এমডি নিয়োগের নতুন একটি নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নীতিমালায়ও একই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর তার প্রথম দফার এমডি নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়। দ্বিতীয় দফায় নিয়োগের জন্য গত ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ নাম সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন চাওয়া হয়। পরে তাকে পাঁচ বছরের জন্য এমডি হিসেবে পুনর্নিয়োগের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যাংকের পাশাপাশি নিজেদের তৈরি করা নির্দেশনাও নিজেরাই ভঙ্গ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ দিকে তার পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে আর্থিক অনিয়ম পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল। প্রতিবেদন পর্যালোচনা দেখা যায়, যমুনা ব্যাংকের এমডির বেতনভাতা পরিশোধের জন্য ব্যাংকটির দিলকুশা শাখায় একটি হিসাব পরিচালিত (হিসাব নং-১১০২০০০০১৫৮৯৯)। এতে ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেতনভাতা ও অপরাপর সুবিধার অর্থ হিসাবটিতে জমা হওয়ার পাশাপাশি নগদ এবং অন্য ব্যাংক থেকে অনলাইন ট্রান্সফারের মাধ্যমে প্রায় ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার টাকা জমা হয়েছে। তবে এ অর্থের কোনো উৎস খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল। নগদ জমা ও অন্য ব্যাংক হতে অনলাইন ট্রান্সফারের ভাউচারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানোর জন্য বলা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্দেশনা থাকার পরও নগদ জমা ও অনলাইন ট্রান্সফারের কোনো ভাউচার বাংলাদেশ ব্যাংকে সরবরাহ করেনি ব্যাংকটি। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অনেক সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন দিক বিবেচনা নিয়ে অনাপত্তি দিয়ে থাকে। সেটা তাও ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১’-এর ৪৫ ধারার ক্ষমতাবলে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজেদের নিয়মের পরিপন্থী কোনো বিষয়ে অনাপত্তি না দেয়ার বিষয়ে মতামত দেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ম করেছে। আবার তারাই যদি সেই নিয়ম পরিপন্থী বিষয়ে অনাপত্তি দেয়, তাহলে বিষয়টি দৃষ্টিকটু লাগে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বর্তমান এমডির আমলে খেলাপি ঋণ ব্যাপকহারে বেড়েছে বলেও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের তুলনায় খেলাপি ঋণ ৪৪১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৯৬০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা হয়েছে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ।

জানা যায়, ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০ কোটি ৬৯ লাখ টাকার খেলাপিযোগ্য ঋণকে গত বছরের জুনের মধ্যে নিয়মিত করার শর্তে অশ্রেণীকৃত রাখা হয়। তবে এ সময়ের মধ্যে ঋণটি আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় নতুনভাবে ১৮৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকার ঋণ খেলাপি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল। ব্যাংক ও এমডির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, একই শাখায় তিন বছরের বেশি সময় ৮৩২ কর্মকর্তা কর্মরত থাকলেও কোনো কর্মকর্তাকে যথাসময়ে বদলি করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকটির মানবসম্পদ বিভাগ এবং এমডির দুর্বল ব্যবস্থাপনার পরিচায়ক হিসেবে অভিহিত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল।

এতো কিছুর পরেও স্বপদে টিকে আছে  ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আওয়ামীলীগ এর সময় প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে সদর্পে চলা এমডি এখনো চলছে সমান তালে। কোথায় তার ক্ষমতার উৎস।

Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন