ফ্রিল্যান্সিং কাজের বৈদেশিক রেমিট্যান্স আয় করমুক্ত নাকি করযোগ্য?
অনলাইন ডেস্ক :
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:০২ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের তরুণ ও দক্ষ পেশাজীবীদের মধ্যে রিমোট ওয়ার্কের জনপ্রিয়তা দ্রুত বেড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোম্পানি এখন বাংলাদেশের কর্মীদের বিপিও, ফ্রিল্যান্সিং ও চুক্তিভিত্তিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে রিমোটভাবে কাজের সুযোগ দিচ্ছে। এসব কাজের মাধ্যমে অনেকেই বিদেশি মুদ্রায় আয় করছেন এবং তা আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে পাঠাচ্ছেন। এ কারণে একটি সাধারণ ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে, বিদেশ থেকে টাকা এলে তা রেমিট্যান্স এবং তাই করমুক্ত। কিন্তু বাস্তবে আয়কর আইন ২০২৩ এ এই আয়ের করযোগ্যতা সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আইন অনুযায়ী রিমোট কাজ বা বিপিও থেকে প্রাপ্ত আয় করমুক্ত হবে কি না, তা প্রধানত নির্ভর করে ব্যক্তির কর-নিবাসী অবস্থান এবং আয়ের উৎস কোথায়, তার ওপর।
মূল প্রশ্নটি অন্যত্র, কারা রেসিডেন্ট করদাতা? আইনের ধারা ২৬–এ স্পষ্ট বলা হয়েছে, যিনি ‘রেসিডেন্ট’ বা নিবাসী হিসেবে বিবেচিত, তিনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই আয় করুন না কেন, তার সব আয় করের আওতায় আসবে। ধারা ২(৪৫) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি করবর্ষে অন্তত ১৮৩ দিন বাংলাদেশে অবস্থান করেন, অথবা ৯০ দিনের সঙ্গে আগের চার বছরে মোট ৩৬৫ দিন থাকেন, তাহলে তিনি রেসিডেন্ট করদাতা। অর্থাৎ যারা দেশে বসে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য রিমোট কাজ করছেন, তাদের অধিকাংশই এই সংজ্ঞা অনুযায়ী রেসিডেন্ট করদাতা, এবং তাদের বৈশ্বিক আয় করযোগ্য।
এখন প্রশ্ন, যখন আয়টি বিদেশ থেকে আসে, তখন কি সেটি বিদেশি উৎসের আয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে? কর নির্ধারণে ‘আয়ের উৎস’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ধারা ২৭–এ বলা হয়েছে, যে আয় বাংলাদেশে ‘উপার্জিত, উপচিত বা উদ্ভূত’ বলে গণ্য হবে, সেই আয় করযোগ্য। আপনি দেশে বসে যদি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে সেবা দেন, তবে সেই সেবার বিনিময়ে যে অর্থ পান, তা বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স হিসেবে এলেও বাংলাদেশের উৎস হতে অর্জিত আয় হিসেবে বিবেচিত হবে। সুতরাং এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে করমুক্ত নয়। আরও উল্লেখ আছে, বাংলাদেশে সম্পাদিত চাকরি বা সেবা, বাংলাদেশে অবস্থিত স্থাপনা বা সম্পত্তি থেকে অর্জিত আয়, সরকার বা নিবাসীর প্রদত্ত ফি, সুদ, রয়্যালটি, কারিগরি সেবা ইত্যাদি সবই বাংলাদেশের উৎসের আয় হিসেবে ধরা হবে।
তবে আইন কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে করমুক্ত সুবিধা প্রদান করে। আয়কর অধ্যাদেশের ষষ্ঠ তফসিলের প্রথম অংশের ধারা ১৭–তে উল্লেখ আছে, বাংলাদেশের কোনো স্বাভাবিক করদাতা বিদেশে আয় উপার্জন করলে এবং সেই আয় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে আনয়ন করলে, সে আয় মোট আয়ের হিসাব থেকে বাদ যাবে, অর্থাৎ করমুক্ত হবে। কিন্তু এই সুবিধা কেবল করদাতা বিদেশে গিয়ে কাজ করে আয় উপার্জন করেন, সে আয় দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে আনলে করমুক্ত হবে; দেশে বসে রিমোট কাজ করে বিদেশি আয় করলে তা এ সুবিধার আওতায় আসে না, কারণ তারা নন-রেসিডেন্ট হিসেবে গণ্য হন না। ফলে যারা দেশে থেকেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, তারা এই করমুক্ত সুবিধা পাবেন না।
তাছাড়া প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসা আয়ের কিছু খাতে বিশেষ করমুক্ত সুবিধা রয়েছে। ষষ্ঠ তফসিলের প্রথম অংশের ধারা ২১ অনুযায়ী, ১ জুলাই ২০২৪ থেকে ৩০ জুন ২০২৭ পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর সমাধান উন্নয়ন, ব্লকচেইন সমাধান উন্নয়ন, রোবোটিক প্রসেস আউটসোর্সিং, সফটওয়্যার অ্যাজ এ সার্ভিস, সাইবার সিকিউরিটি সেবা, ডিজিটাল ডেটা অ্যানালিটিক্স ও ডেটা সায়েন্স, মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার উন্নয়ন ও কাস্টমাইজেশন, সফটওয়্যার টেস্ট ল্যাব সেবা, ওয়েব লিস্টিং ও ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, আইটি সাপোর্ট ও সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্স, জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সেবা, ডিজিটাল অ্যানিমেশন ও গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল ডেটা এন্ট্রি ও প্রসেসিং, ই–লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ও ই–পাবলিকেশন, আইটি ফ্রিল্যান্সিং, কল সেন্টার সেবা এবং ডকুমেন্ট কনভারশন, ইমেজিং ও ডিজিটাল আর্কাইভিং, এসব খাতে নিবাসী বা অনিবাসী যেকোনো স্বাভাবিক ব্যক্তির ব্যবসা থেকে অর্জিত আয় করমুক্ত হিসেবে গণ্য হবে। তবে এই সুবিধা তখনই প্রযোজ্য, যখন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সেবাটি ব্যবসা হিসেবে পরিচালনা করে এবং সব আর্থিক লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে সম্পন্ন করে। এজন্য প্রয়োজনীয় ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন এবং বিআইএন নিতে হবে।
আরেকটি দায়িত্বশীলতার বিষয় হলো উৎসে কর কর্তন। ধারা ১২৪ অনুযায়ী, রেসিডেন্ট’ বা নিবাসী করদাতার বিদেশ থেকে সেবা ফি বা রেভিনিউ শেয়ারিং দেশে এলে এবং তা বাংলাদেশের ভেতর সম্পাদিত সেবার বিনিময় হিসেবে বিবেচিত হলে ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা বাধ্যতামূলক। ব্যাংক অনেক সময় রেমিট্যান্সের টাকা ব্যাংক একাউন্টে জমা দেওয়ার সময়ই এই কর কেটে রাখে। ধারা ১৫০ অনুযায়ী, এই উৎসে কাটা কর রিটার্নে মোট করদায়ের সঙ্গে সমন্বয় করতেই হবে। কিন্তু অনেক করদাতা ব্যাংক থেকে কর্তিত করের চালান সংগ্রহ করেন না, ফলে তারা ইতোমধ্যে দেওয়া করের সুবিধা রিটার্নে ভোগ করতে পারেন না।
রিমোট কাজের আয় করযোগ্য হবে কি না, তা নির্ভর করে ব্যক্তি ব্যবসায় নিযুক্ত আছেন নাকি চাকরিজীবী—তার ওপর। আপওয়ার্ক, ফাইভার বা প্রজেক্টভিত্তিক চুক্তির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ ব্যবসায়িক আয় হিসেবে গণ্য হয় এবং যদি তা আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসার মানদণ্ড পূরণ করে, তবে করমুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকতে পারে। কিন্তু কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিয়মিত বেতন পেলে তা চাকরিজনিত আয় হিসেবে বিবেচিত হবে এবং বাংলাদেশে কর দিতে হবে। করমুক্ত রেমিট্যান্স সুবিধা কেবল তাদের জন্য প্রযোজ্য, যারা শারীরিকভাবে বিদেশে কর্মরত থেকে আয় উপার্জন করেন এবং সেই আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠান। রিমোট কর্মীরা বাংলাদেশ থেকেই সেবা প্রদান করেন, তাই তাদের আয় বিদেশে কর্মসংস্থানজনিত করমুক্ত রেমিট্যান্স হিসেবে গণ্য হয় না এবং দেশীয় কর বিধান অনুযায়ী তা করযোগ্য থাকে।
তাই বৈশ্বিক কর্মক্ষেত্রে যুক্ত তরুণদের জন্য কর-দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। রিমোট কর্মীদের অনেকেই যুক্তিসঙ্গতভাবেই প্রশ্ন করেন, দেশে বসে অর্জিত আয় যখন ব্যক্তি নিজ প্রচেষ্টায় আসে, তখন কেন তার উপর কর আরোপ? এর উত্তর সহজ, রাষ্ট্রের করব্যবস্থা নাগরিকের অবস্থান, কর্মকাণ্ড ও আয়ের উৎসের ভিত্তিতে কাজ করে। রাষ্ট্র কর আদায় করে জনস্বার্থে ব্যয় করার জন্য। তাই বৈশ্বিক কর্মবাজারে যুক্ত হওয়া প্রশংসনীয় হলেও করদায়িত্ব এড়ানো বা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা রাষ্ট্র ও ব্যক্তির, উভয়ের ক্ষতির কারণ।
আজকের ডিজিটাল অর্থনীতিতে রিমোট কাজ একটি অনিবার্য বাস্তবতা। এই বাস্তবতা আইনকে নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। তাই প্রয়োজন আইন সম্পর্কে সচেতনতা এবং নিজের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। রেমিট্যান্স মানেই করমুক্ত, এই ধারণা থেকে বের হতে হবে। করের আওতায় যা পড়ে, তা যথাযথভাবে ঘোষণা ও পরিশোধ করা নাগরিক দায়িত্বের অংশ। রাষ্ট্র রাজস্বে স্বচ্ছতা চায়, ব্যক্তি চায় নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা। এই দুইয়ের মিলনেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায়। রিমোট কর্মীরা যদি আইন বোঝেন এবং সঠিকভাবে কর রিটার্ন দাখিল করেন, তবে ব্যক্তি ও রাষ্ট্র- উভয়ই উপকৃত হবে। ভুল ধারণা নয়, আইনের সঠিক ব্যাখ্যাই হোক আমাদের পথপ্রদর্শক।
লেখক: আর্থিক খাতের বিশ্লেষক



