বাইরের টাকা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ফেরায় আমানত দুই ডিজিটে
শামসুল আলম সেতু
প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:২১ পিএম
ছবি-প্রতীকী
ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার একটি অংশ পুনরায় ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ফেরত আসায় আমানতের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। আমানত বাড়ায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে দুই ডিজিটে। গত দেড় বছর ব্যাংকগুলোতে এই আমানতের পরিমান সিংগেল ডিজিটে ছিল। ব্যাংকে আবারও আমানত বাড়ার পেছনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ কাজ করছে, যার মধ্যে প্রধান কারণ ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার হ্রাস পাওয়া। ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক সংশ্লিষ্টরা এসব বিষয়ে জোর যুক্তি প্রদর্শন করেন। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরায় আমানত বাড়ছে।
জানা গেছে, দেশের ব্যাংক খাতে ১৭ মাস পর আমানতের প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে ফিরেছে। চলতি বছরের আগস্ট মাস শেষে আমানতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১০.০২ শতাংশে, যা ব্যাংক খাত ও অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করছে। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার কমে যাওয়ায় এই খাতে বিনিয়োগ কমেছে, যা ব্যাংকের আমানতে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.৪৩ শতাংশ। দীর্ঘ সময় ধরে, অর্থাৎ ২০২৪ সালের মার্চ থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত, ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল এক অঙ্কে (জুলাই মাসে যা নেমে গিয়েছিল ৮.৫০ শতাংশে)।
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকে আবারও আমানত বাড়ার পেছনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ কাজ করছে, যার মধ্যে প্রধানতম কারণ হলো ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার হ্রাস পাওয়া।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রেজারি বিল ও বন্ডে সুদ কমে যাওয়ায় ব্যক্তি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে বিনিয়োগ কমিয়ে এখন ব্যাংকের আমানতে বিনিয়োগ করছে। মাত্র তিন মাস আগেও ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার ১১ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে থাকলেও, অক্টোবর নাগাদ তা ১০ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে। বর্তমানে ট্রেজারি বিল-বন্ড ও ব্যাংক আমানতের সুদের হার প্রায় সমান। তবে গত তিন মাসে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার ২০০ বেসিস পয়েন্টের বেশি কমে যাওয়ায় এই খাতে বিনিয়োগ কমেছে, যা ব্যাংকের আমানতে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ আলী বলেন, "ট্রেজারি বিল–বন্ডের সুদের হার কমছে। এজন্য অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান নতুন করে এ খাতে বিনিয়োগ করছে না। ফলে তারা ব্যাংকের আমানতে বিনিয়োগ করছে। ব্যাংকের বাইরে থাকা ক্যাশের (কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক) পরিমাণও কমেছে এবং এর বড় একটি অংশ আবার ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ফিরে এসেছে।"
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও একই মত দিয়ে বলেন, "ট্রেজারি বিল–বন্ডের সুদের হার কমায় অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের আমানতে বিনিয়োগ শুরু করেছে।"
আমানতের প্রবৃদ্ধি বাড়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং রেমিট্যান্স প্রবাহও ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসেইন। তিনি বলেন, "কিছুদিন আগে ব্যাংক খাতে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় আমানত কমে গিয়েছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা ফিরেছে, ফলে এখন আমানত বাড়ছে।"
বর্তমানে ট্রেজারি বিলের সুদের হার এক অঙ্কে নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ নিলাম অনুযায়ী ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদের হার দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯.৫০ শতাংশ, ৯.৭১ শতাংশ এবং ৯.৬০ শতাংশে। এছাড়া ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার যথাক্রমে ৯.৩৩ শতাংশ, ৯.৮৯ শতাংশ, ৯.৬৭ শতাংশ এবং ৯.৭০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার ক্রয়ও ব্যাংকের তারল্য বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। এক বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান জানান, "কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নিলামের মাধ্যমে ডলার কিনেছে। এতে ব্যাংক খাতে আগের তুলনায় তারল্য বেড়েছে। ১৫টি নিলামের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ২ বিলিয়নের বেশি ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।" তিনি আরও বলেন, "সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমায় ব্যাংক আমানত এখন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জনগণের হাতে থাকা ক্যাশের (কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক) পরিমাণও কমেছে। চলতি বছরের আগস্ট মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা ক্যাশের পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ কমে ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ২ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে, ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার একটি অংশ আবার ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ফেরত আসছে।



