মূল্যস্ফীতি কমলেও স্বস্তি নেই সাধারণ মানুষের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০৫ পিএম
দেশে সরকারি হিসাবে গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বাস্তবে তার প্রভাব পড়েনি সাধারণ মানুষের জীবনে। রাজধানীর মধুবাগের বড় মুদি দোকান আলী জেনারেল স্টোরের মালিক মো. আয়াত আলী বলছেন, মানুষের আয় কমে যাওয়ায় তার দোকানে বিক্রি কমেছে ২০–২৫ শতাংশ। একই এলাকার গৃহকর্মী সুলতানা খানম জানালেন, পরিবারের খরচ মেটাতে আগের তিনটি বাসার বদলে এখন পাঁচটি বাসায় কাজ করতে হচ্ছে তাকে, কিন্তু খাবারের পরিমাণ কমে গেছে আগের তুলনায়।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ২০২৪ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। বছর শেষে তা কমে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশে দাঁড়ালেও বাজারে দাম কমেনি। নিত্যপণ্যের দাম এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি কমা মানে পণ্যের দাম কমা নয়। এখনো দাম বাড়ছে, শুধু বাড়ার হার কিছুটা কমেছে। আগে ১২ শতাংশ হারে দাম বাড়ত, এখন বাড়ছে ৮ শতাংশ হারে—কিন্তু বাড়ছেই তো।
মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এক বছরে তিন দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করেছে। ফলে ঋণের সুদহার ১৫ শতাংশের ওপরে চলে গেছে, যা বিনিয়োগে স্থবিরতা সৃষ্টি করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশে নামানোর লক্ষ্য নিয়েছে। তবে ড. জাহিদ হোসেনের মতে, সরকার মূল্যস্ফীতির গতিকে কিছুটা কমাতে পারলেও সাধারণ মানুষের জীবনে এর সুফল পৌঁছায়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকার ডলারের দাম ১২২ টাকায় স্থির রেখে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে বাধা দিচ্ছে। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ডলারের দাম যদি ১২০ টাকায় নামত, তাহলে আমদানির খরচ কমে মূল্যস্ফীতি আরও কমত। সরকার রপ্তানি বাঁচাতে গিয়ে জনগণকে মূল্যস্ফীতির বোঝা দিয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির প্রায় ৪৮ শতাংশই আসে চাল থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমলেও দেশে তা চড়া রয়ে গেছে। কারণ কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় মানুষের আয় কমেছে, ফলে চালে নির্ভরতা বেড়েছে।
বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসির গবেষণায় বলা হয়েছে, এখন একটি পরিবারের মাসিক মোট ব্যয়ের ৫৫ শতাংশ খাবার কেনায় খরচ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রশ্ন তুলেছেন, সরকারি মূল্যস্ফীতি হিসাব বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না। তার মতে, টিসিবির খুচরা মূল্যতালিকা অনুযায়ী প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে, অথচ সরকারি তথ্য বলছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যা অবাস্তবভাবে কম।
পিপিআরসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার তিন বছরে ১৮ দশমিক ৭ থেকে বেড়ে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে উঠেছে। অতিদারিদ্র্য বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
অন্যদিকে, বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। আগস্টে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে, যা ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে মূল্যস্ফীতি কমছে মূলত চাহিদা হ্রাসের কারণে। বিনিয়োগ কমে কর্মসংস্থান ও আয় হ্রাস পেয়েছে, ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তাই মূল্যস্ফীতি কমলেও তা জনগণের জন্য স্বস্তি বয়ে আনেনি—বরং আয় কমা, দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও খাদ্যগ্রহণ কমে যাওয়া এখন দেশের সবচেয়ে বড় সংকটে পরিণত হয়েছে।



