বড় প্রকল্পে বছরজুড়ে বিলম্ব: দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতাই মূল বাধা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
বাংলাদেশের বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে দীর্ঘ বিলম্ব এখন প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। শুরুতে নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রম করে প্রকল্প শেষ হতে লাগে দ্বিগুণ বা ততোধিক সময়। এতে ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে গেলেও কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সমন্বয়ের অভাব এবং অদক্ষ প্রকল্প পরিচালনা।
সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক উচ্চপর্যায়ের কর্মসভায় বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) জানায়, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা, বিদ্যুৎ-গ্যাস-টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো স্থানান্তরে দীর্ঘসূত্রতা এবং অভিজ্ঞ প্রকল্প পরিচালকের অভাব বড় প্রকল্পে বিলম্বের প্রধান কারণ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মূল্যায়ন শাখা প্রস্তাব করেছে—এই সহায়ক কাজগুলোকে আলাদা প্রকল্প হিসেবে আগে শেষ করা হোক, যাতে মূল অবকাঠামো নির্মাণে গতি আসে।
আইএমইডির সচিব মো. কামাল উদ্দিন সভায় বলেন, পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগের নিয়ম থাকলেও বাস্তবে অনেককে একসঙ্গে একাধিক প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে কোনো প্রকল্পই সঠিকভাবে এগোয় না। অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে পিডি করা, ঘন ঘন বদলি এবং প্রশিক্ষণের অভাব প্রকল্পকে ঝুলিয়ে রাখে। এজন্য তিনি বিশেষ প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি “পিডি পুল” গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন।
আইএমইডির উপস্থাপিত প্রবন্ধে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ২৫টি বড় সমস্যা তুলে ধরা হয়। প্রণয়ন ধাপে দুর্বল সম্ভাব্যতা যাচাই, অসম্পূর্ণ নকশা, ব্যয় অনুমানে ত্রুটি, পর্যাপ্ত আলোচনার অভাব এবং পরামর্শকদের ওপর অতিনির্ভরশীলতা উল্লেখ করা হয়। বাস্তবায়ন ধাপে সমস্যা হিসেবে আসে পরিদর্শন প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে গড়িমসি, মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবে বিলম্ব, বাস্তবায়নকারী সংস্থার সমন্বয়হীনতা এবং উন্নয়ন সহযোগীদের অনুমোদন পেতে দীর্ঘসূত্রতা। সমাপ্তির পরও রয়ে যায় দুর্বলতা—প্রতিবেদন দাখিলে দেরি, রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি ও জনবল সংকট।
এমন বিলম্ব ব্যয়ের বোঝা বাড়াচ্ছে প্রকল্পগুলোতে। যেমন—ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম ধাপে ব্যয় নির্ধারিত ছিল প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা, যা দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার কোটির বেশি। একই অভিজ্ঞতা হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পেও।
অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফা কে মুজেরি বলেন, এই সমস্যা বহু দশক ধরে চলমান। প্রতিবার সুপারিশ দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয় না, কারণ আইএমইডির নিজস্ব ক্ষমতা নেই।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিদেশি অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বল ব্যবস্থাপনা আরও জটিল প্রভাব ফেলে। উন্নয়ন সহযোগীরা সমন্বয়ের অভাব বা বারবার ব্যয় ও সময় বাড়ানো দেখে নতুন অর্থায়নে অনাগ্রহী হন, যা ভবিষ্যতের বিনিয়োগ ব্যাহত করে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, সমন্বয়হীনতা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনা অব্যাহত থাকলে সরকারের ঘোষিত ২০৪১ সালের উন্নয়ন রূপরেখা হুমকির মুখে পড়বে। কারণ দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মূল ভরকেন্দ্রই অবকাঠামো উন্নয়ন।
তাদের মতে, এডিপি বাস্তবায়নের গড় হার এখনো ৮০ শতাংশের নিচে, অথচ লক্ষ্য অর্জনে এটি হতে হবে ৯৫ শতাংশ। এজন্য প্রণয়ন পর্যায় থেকেই শক্তিশালী নজরদারি, প্রকল্প পরিচালকের নিয়োগে কঠোরতা, আলাদা ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প এবং সময়সীমা মেনে চলা বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি আইএমইডিকে সুপারিশ কার্যকর করার ক্ষমতা দিতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এখন জরুরি হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক সংস্কার। তা না হলে বড় প্রকল্পগুলো ঝুলে থেকে ব্যয় বাড়াবে, আর উন্নয়ন লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।



