বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধাররা নিষিদ্ধ হওয়ায় পুঁজিবাজারে স্বস্থি
শামসুল আলম সেতু
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:২৩ পিএম
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বহুল আলোচিত নাম বেক্সিমকো গ্রুপ। দীর্ঘদিন ধরেই এই গ্রুপকে ঘিরে নানা বিতর্ক থাকলেও এবার সরাসরি বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন) ইতিহাসের সবচেয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, তার ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানকে পুঁজিবাজার থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং আইএফআইসি ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের সাবেক সিইও ইমরান আহমেদকে বাজার থেকে ৫ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে কেউ কেউ আখ্যা দিচ্ছেন "দৃঢ় নিয়ন্ত্রক অবস্থান" হিসেবে, আবার কারও মতে—"এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য একধরনের আস্থাহীনতার বার্তা"।
বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক বন্ড ‘আল ইসতানিয়া’ এবং আইএফআইসি গ্যারান্টেড শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে প্রতারণামূলক যোগসাজশ, প্রভাব খাটানো, ক্ষমতার
অপব্যবহার ও দায়িত্বহীন আচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।
গত ৩ সেপ্টেম্বর বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মকসুদ স্বাক্ষরিত আদেশ জারি করা হয়।
আরোপিত শাস্তি ও সিদ্ধান্ত
•সালমান এফ রহমান: ১০০ কোটি টাকা জরিমানা + আজীবন নিষিদ্ধ
•আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমান: ৫০ কোটি টাকা জরিমানা + আজীবন নিষিদ্ধ
•ইমরান আহমেদ (সাবেক সিইও, আইএফআইসি ইনভেস্টমেন্টস): ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ
•শাহ আলম সারওয়ার (সাবেক এমডি, আইএফআইসি ব্যাংক): এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রমের মুখোমুখি হবেন
•আইএফআইসি ব্যাংককে সতর্ক করা হয়েছে
•তৎকালীন পরিচালক এ আর এম নাজমুস সাকিব, গোলাম মোস্তফা, জাফর ইকবাল, কামরুন নাহার আহমেদ এবং স্বাধীন পরিচালক সুধাংশু শেখর বিশ্বাসকে সতর্ক করা হয়েছে
•ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেডকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে
বিএসইসির মন্তব্য
কমিশন জানিয়েছে, সালমান এফ রহমান তার প্রভাব খাটিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে এসব প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন, যা দেশের পুঁজিবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং বিনিয়োগকারীর স্বার্থকে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে।
এ কারণে উভয়কে ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করা হয়েছে। এখন থেকে তারা কোনো স্টক এক্সচেঞ্জ, মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান, তালিকাভুক্ত কোম্পানি বা কমিশনের অনুমোদনসাপেক্ষ কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না এবং এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে প্রবেশ বা আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমেও অংশ নিতে পারবেন না।
অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ
অর্থনীতিবিদদের মতে, পুঁজিবাজার একটি আস্থাভিত্তিক খাত। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ছাড়া এখানে বিনিয়োগ টেকসই হতে পারে না। তাদের ভাষায়—
•"এটি আস্থাহীনতার সংকেত নয়, বরং আস্থা ফেরানোর সুযোগ।"
•"বড় উদ্যোক্তা বা প্রভাবশালী হোক, কেউ নিয়ম ভাঙলে শাস্তি পেতে হবে—এই বার্তাই দেওয়া হয়েছে।"
বাজারে সম্ভাব্য প্রভাব
•স্বল্পমেয়াদে: শেয়ার বাজারে চাপ সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে ব্যাংক ও বেক্সিমকো গ্রুপ সংশ্লিষ্ট সিকিউরিটিজে।
•দীর্ঘমেয়াদে: শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা ফিরতে পারে। বিনিয়োগকারীরা বুঝবেন, বাজারে আর কারও অবাধ ক্ষমতা নেই।
•আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীর চোখে: নিয়ন্ত্রকের দৃঢ়তা বাংলাদেশকে "অন্তত কাগজে-কলমে" একটি সুশাসিত বাজার হিসেবে তুলে ধরতে পারে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অতীতে বেশ কয়েকবার আস্থা সংকটে পড়েছে— ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের ধস এখনও বিনিয়োগকারীদের মনে গেঁথে আছে। এবার সালমান এফ রহমান ও তার ছেলেকে আজীবন নিষিদ্ধ করার ঘটনা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক।
এটি যদি কেবল কাগজে আটকে না থেকে বাস্তবায়িত হয়, তবে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে।



