Logo
Logo
×

অর্থনীতি

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক : অতি আত্মবিশ্বাসের খেসারত দিচ্ছে বাংলাদেশ

Icon

শামসুল আলম সেতু :

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৫, ১০:০১ পিএম

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক : অতি আত্মবিশ্বাসের খেসারত দিচ্ছে বাংলাদেশ

অতি আত্মবিশ্বাসের খেসারত দিচ্ছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় অতিমাত্রায় কৌশলী হয়ে প্রতিযোগী দেশগুলো কীভাবে এই শুল্ক পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে সেটিও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি হয়ে পড়েছেশুধু আশা নিয়ে বসে থাকলে হবে নাকাঠামোগত কূটনৈতিকঅর্থনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবেপ্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ দিয়ে এই শুল্ক বিষয়ক আলোচনাকে এগিয়ে নিতে হবে।’বাংলাদেশ আগামী দিনে কোথায় যাবে, তা নির্ধারণে এই নতুন শুল্ক ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করছে

রাজনৈতিক বৈধতাপ্রশাসনিক সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে সরকারের নেগোশিয়েশন (দর কষাকষি) সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ-এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কোনও দুর্বল এবং অসমন্বিত সরকারের যদি রাজনৈতিক বৈধতা না থাকে, তাহলে তাদের সফলভাবে দর কষাকষি করার নজির বিরল

বাড়তি শুল্কের বোঝা কীভাবে ভাগাভাগি করা যায়, সে বিষয়ে কৌশলী আলোচনা করার তাগিদ অপরিহার্য হয়ে উঠেছেঅনেকে মনে করেন, কারও মাথার ওপর কেউ আছেন-তিনি এক ফুঁ দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবেকিন্তু বাস্তবতা অন্যরকমএমনটি উঠে এসেছে এক আলোচনায়

রবিবারযুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: কোন পথে বাংলাদেশশীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়অনুষ্ঠানটি দৈনিক প্রথম আলো রাজধানীর এক হোটেলে আয়োজন করেএতে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ীগবেষকেরা অংশ নেন

অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা বিশ্লেষক লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের যে ডকুমেন্ট নিয়ে আমরা কথা বলছি, তার ভেতরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কথাবার্তা চলে এসেছেযুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের ধারণার মধ্যে ১৮ কোটি মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অংশ রয়েছেচীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর তাগাদা দেওয়ার বিষয়ও আছেবাংলাদেশকে দুটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করতে হবেআমরা যদি চুক্তি সই করি, তা ১৮ মাসের মধ্যে কার্যকর হয়ে যাবেঅথচ সংবিধানের আদর্শিক জায়গার সঙ্গে তা যায় কি না বা আঞ্চলিক শক্তির ক্ষেত্রে বিপৎসীমা অতিক্রম করা হচ্ছে কি না, সেটিও সমীক্ষা করার দরকার আছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করছি, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের বিষয়টি ভূরাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিকভূকৌশলগত খেলার অংশআমরা শুনে আসছি যেঅঞ্চলে শক্তিমত্তা সৃষ্টির জন্য যুক্তরাষ্ট্র সচেষ্টবাংলাদেশ এখন তার অংশ হয়ে গেছেভবিষ্যতের ভূরাজনৈতিক শক্তিমত্তা প্রদর্শিত হবে ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করেপ্রতিবেশী দেশের ভেতর দিয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করছে চীনআমরা আমেরিকার অর্থনৈতিক যে শুল্ক চাপ দেখছি তার সঙ্গে ভূরাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিকভূ-কৌশলগত বিষয় সবই জড়িত।’

রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে কিছু তথ্য উল্লেখ করে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্ব ২০২৩ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা বিষয়ে ২৫৩ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা করেছে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একাই দিয়েছে ১৬১ কোটি ডলার। ভারত কোনো পয়সা দেয়নি। আর চীন ২০ লাখ ডলার ও রাশিয়া ৪ লাখ ডলার দিয়েছে। এদিকে ২০১৭ সালের পর মিয়ানমারকে ১৪ শতাংশ অস্ত্র দিয়েছে ভারত। চীন ২৯ শতাংশ ও রাশিয়া ৪৯ শতাংশ অস্ত্র দিয়েছে। রাশিয়া ও চীন মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে। আঞ্চলিক শক্তি ও পরাশক্তির বিপৎসীমা অতিক্রম না করে তাদের থেকে সুবিধা আদায় করতে হবে আমাদের।’

দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও আন্তর্জাতিক বিষয়ে ‘নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট’ (এনডিএ) সই হতে দেখলেন বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “বিষয়টি ইতিহাসে এই প্রথম দেখলাম একটি বিষয়কে নন-পেপার না করে সরাসরি এনডিএ করা হয়েছে। যার ফলে এটি এখন একটি বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এখন যদি বাংলাদেশ কোনও লবিস্ট নিয়োগ করে, তার কাছেও এ তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, আমরা কর্দমাক্ত জায়গায় নিষ্পাপ সরকার নিয়ে এগোচ্ছি। এমন নির্দোষ আর নিষ্পাপ সরকার আমি আগে দেখিনি।” রাজনৈতিক বৈধতা ও প্রশাসনিক সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে সরকারের নেগোশিয়েশন (দর কষাকষি) সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ-এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, কোনও দুর্বল এবং অসমন্বিত সরকারের যদি রাজনৈতিক বৈধতা না থাকে, তাহলে তাদের সফলভাবে দর কষাকষি করার নজির বিরল।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ নীতিকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই মনে করেন না এই অর্থনীতিবিদ। তার ভাষায়, “এই উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য একটি ওয়েক-আপ কল।” তিনি মনে করেন, এই সংকট পণ্য বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরির জন্য বাংলাদেশের সামনে একটি বড় বার্তা এনে দিয়েছে।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, “বাংলাদেশ আগামী দিনে কোথায় যাবে, তা নির্ধারণে এই নতুন শুল্ক ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করছে।” এ আলোচনা অনুষ্ঠানে অন্যান্য বক্তাও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য কূটনীতি, শুল্কনীতি এবং লবিংয়ের কৌশল নিয়ে মতামত দেন।


বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত পাল্টা শুল্ক ইস্যুতে সরকার শুরুতে অতি আত্মবিশ্বাসী ছিল। তারা ভেবেছিল, আলোচনার মাধ্যমে সহজেই বিষয়টি সমাধান করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে এখন দেশের রফতানি খাতকে এর বড় মূল্য দিতে হচ্ছে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘পাল্টা শুল্ক নিয়ে সরকারের কিছু মহলে এক ধরনের কৃতিত্ব নেওয়ার মানসিকতা কাজ করেছে। নীতিনির্ধারক মহলে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, আলোচনার মাধ্যমে এই শুল্ক হয়তো ১০ শতাংশ কিংবা শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। ফলে এখন আমরা এক ধরনের অতি আত্মবিশ্বাসের খেসারত দিচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘শুধু নিজেদের অবস্থান নয়, প্রতিযোগী দেশগুলো কীভাবে এই শুল্ক পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে সেটিও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। পাশাপাশি অশুল্ক বাধা, ভূরাজনৈতিক কৌশল এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়গুলোও হিসাবের মধ্যে আনতে হবে।’

বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় পোশাক সরবরাহকারী দেশ। এক দিনে এই দেশ থেকে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। বরং তারা দর-কষাকষির জায়গা খুঁজবে। উদ্যোক্তাদের উচিত হবে ক্রেতাদের সঙ্গে বসে এই বাড়তি শুল্কের বোঝা কীভাবে ভাগাভাগি করা যায়, সে বিষয়ে কৌশলী আলোচনা করা।’

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার। এই বাজার ধরে রাখা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে ভারতসহ অনেক দেশ এই পরিস্থিতিকে নিজেদের সুযোগ হিসেবে নিতে চাইছে। ফলে আমাদের এখন অতিমাত্রায় কৌশলী হতে হবে।’

তিনি আরও জানান, ‘বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে, তা হলোএই পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। ভবিষ্যতে এটি কতদিন স্থায়ী হবে, তা এখনও অনিশ্চিত। কিন্তু এই আলোচনায় শুধু ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) নয়, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অতএব, এখন কেবল দ্বিপক্ষীয় আলোচনা নয়, বরং স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ও উচ্চপর্যায়ের লবিংয়ের প্রয়োজন রয়েছে।’

সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো বলেন, ‘শুধু আশা নিয়ে বসে থাকলে হবে না। কাঠামোগত কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ দিয়ে এই শুল্ক বিষয়ক আলোচনাকে এগিয়ে নিতে হবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের কারণে তৈরি পোশাক খাতে রফতানি সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকএফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতিকে আজাদতিনি বলেন, “আমার ৪০ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে এমন সংকট আর দেখিনি।”

কে আজাদ বলেন, “আমরা যাদের কাছে রফতানি করি, সেসব বড় ব্র্যান্ড যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে চলমান ট্যারিফ নেগোসিয়েশনের খোঁজ রাখছে এবং লবিং করছেতারা আমাদের স্পষ্ট করে জানিয়েছে, বাংলাদেশের পক্ষে ইতিবাচক ফল আসার সম্ভাবনা খুবই কম।”

তিনি জানান, এ সংকট নিয়ে যখন সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা হয়, তখন লবিস্ট নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। প্রধান উপদেষ্টার দফতরে বার্তা পাঠানো হয়েছিলতখন বলা হয়েছিল ৯৫ শতাংশ সমাধান হয়ে গেছেকিন্তু এখনও পর্যন্ত আমরা কোনও ইতিবাচক অগ্রগতি দেখছি না,।

একজন ক্রেতার সঙ্গে সাম্প্রতিক যোগাযোগের কথা উল্লেখ করেকে আজাদ বলেন, “রবিবার একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড আমাকে মেইল পাঠিয়ে জানতে চেয়েছেআগামীআগস্ট থেকে তৈরি হওয়া পণ্যে যদি নতুন শুল্ক আরোপ করা হয়, তবে তার কত শতাংশ আমি বহন করবোওই ক্রেতার কাছে আমার রফতানির পরিমাণ ৮০ মিলিয়ন ডলার, যেখানে আমার লাভ ১.৩৭ মিলিয়ন ডলারযদি আমাকে ৩৫ শতাংশ শেয়ার করতে হয়, তাহলে আমি টিকবো কীভাবে?”

সরকারের উদ্দেশে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “সাত-আট মাস পর আপনারা (বর্তমান সরকার) চলে যাবেনকিন্তু আমরা কোথায় যাবো? আমাদের ভবিষ্যকী হবে? আমাদের কি আপনারা ঝুঁকিতে ফেলে যাবেন?”

তিনি আরও বলেন, “অনেকে মনে করেন, কারও মাথার ওপর কেউ আছেন তিনি এক ফুঁ দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম।”

আলোচনায় অংশ নিয়ে লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, “আমরা কনফিউজড। বাংলাদেশ সরকার আসলে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ইস্যুতে কী পথে হাঁটছে, সেটি এখনও পরিষ্কার নয়।”

আলোচনায় অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা ও রফতানিকারকরা যুক্তরাষ্ট্রের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফের বিরুদ্ধে শক্ত কূটনৈতিক তৎপরতা ও বেসরকারি খাতের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগের তাগিদ দেন।

Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন