আন্দোলন : ‘গণক্ষমা’ পেতে চান এনবিআর কর্মকর্তারা
নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৯:৪০ এএম
ফাইল ছবি
আন্দোলন এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য। একসময় বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে যারা দর কষাকষি করতেন, এখন তারা দিন কাটাচ্ছেন বহিষ্কার আর দুদক আতঙ্কে। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন তাদের বোধোদয় হয়েছে যে আন্দোলন করা ভুল ছিল। এরই মধ্যে কেউ কেউ ‘গণক্ষমা’ চাওয়ার বিষয়ও ভাবছেন।
গত কয়েকদিনে এনবিআরের ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। একই সময়ে ৬ কর্মকর্তাকে বদলি এবং ৫ কর্মকর্তাকে সাময়িক বহিষ্কার ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে এনবিআর। এসব ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে এনবিআরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে।
কেউ কেউ বলছেন, এনবিআর বিলুপ্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে কঠিন শাস্তির মুখে পড়েছেন তারা। চাকরি বাঁচাতে এরই মধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন কয়েকজন। কেউ আবার যোগাযোগ করছেন চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে। অধিকাংশ কর্মকর্তাই আন্দোলনকে ভুল আখ্যা দিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এনবিআরের যৌক্তিক সংস্কার ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে প্রথমে মে মাসে ও দ্বিতীয় দফায় জুনের শেষ সপ্তাহে আন্দোলন করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সারাদেশের কাস্টম অফিস, বন্দর বন্ধ রেখে গত ২৮ ও ২৯ জুন কমপ্লিট শাটডাউন ও মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি পালন করেন তারা। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে পালন করা হয় এসব কর্মসূচি। পরে ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় গত ২৯ জুন আন্দোলন স্থগিত করে এনবিআর ঐক্য পরিষদ।
এরপর যেন হঠাৎ করেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ২৯ জুন থেকে ৩ জুলাই (৫ দিনে) এনবিআরের ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই ১৬ জনের মধ্যে ১০ জন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য। বাকিদেরও আন্দোলনে অংশ নিতে দেখা গেছে। ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও তিন মুখপাত্রকে দুদকের জালে আটকানোর বিষয়টি ভালো চোখে দেখছেন না এনবিআর কর্মকর্তারা।
তবে দুদক বলছে, যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কর ও শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে করদাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব কর্মকর্তার কারণে প্রতিবছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে- এমন অভিযোগ আনা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা ঘুষ না পেয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার মিথ্যা মামলা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিককে হয়রানি করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে।
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার (৩ ও ৪ জুলাই) এনবিআর ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ কর্মকর্তা গণমাধ্যম এড়িয়ে চলছেন। কেউ কেউ ফোন বন্ধ রেখেছেন। এনবিআর কর্মকর্তাদের নিজস্ব গ্রুপ ও আন্দোলনের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে লিভ নিয়েছেন অনেকেই। সবার মধ্যেই অজানা আতঙ্ক। বড় কর্তাদের (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) বিদায়ের খবরে অনেকেরই মন ভেঙেছে।
দুই দিনে এনবিআরের একজন মহাপরিচালক, কয়েকজন দ্বিতীয় সচিব, একজন সদস্যসহ একডজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য। সবাই একমত যে রাজস্ব প্রশাসনে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কার কখন বদলি, বহিষ্কার কিংবা দুদকের অনুসন্ধানের খবর আসবে- এমন চিন্তা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব কর্মকর্তার কেউ কেউ স্বীকার করেছেন, অর্থবছরের শেষ সময়ে আন্দোলন করা ভুল ছিল। অর্থনীতির ব্লাড লাইন পোর্ট অচল করাও সঠিক হয়নি।
এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাড়ি থেকে বোনকে ঢাকায় এনেছি। তাকে সব বুঝিয়ে বলেছি। আমার চাকরি গেলে বা দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে যাতে বিচলিত না হয়। এটা বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলতে বলেছি। শুনেছি ২৬ জনের তালিকা হয়েছে, সবাইকে বরখাস্ত করবে। এরপর আরও ৫০ জনকে শাস্তি দেওয়া হবে।’
তবে দুদকের অনুসন্ধানের সমালোচনা করে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এতদিন দুদকের অনুসন্ধান করার কথা মনে ছিল না। করুক অনুসন্ধান, কিছুই পাবে না। কিন্তু সমাজে আমাদের ইমেজ খারাপ হবে। দিন শেষে এনবিআরের ক্ষতি হবে।’
শুধু দুদকের তদন্ত নয়, গত কয়েক দিনে এনবিআরের এক কমিশনার ও চার সদস্যকে শাস্তির আওতায় এনেছে সরকার। এছাড়া ২৮ ও ২৯ জুন কারা কারা কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন তাদের তালিকা চাওয়া হয়েছে।
গত ১ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ‘সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে শুল্ক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার’। পরদিন ২ জুলাই অবসরে পাঠানো হয়
যাদের বিরুদ্ধে শাস্তির খড়গ
আন্দোলন প্রত্যাহারের এক সপ্তাহ না যেতেই পাঁচ সিনিয়র কর্মকর্তাকে বরখাস্ত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। দুদক এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে আরও জ্যেষ্ঠ ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
গত ৩ জুলাই দুই কমিশনারসহ ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। তারা হলেন- ঢাকা পূর্বের কমিশনার (কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট) কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, বেনাপোল স্থলবন্দরের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান, উপ কর কমিশনার মো. মামুন মিয়া, অতিরিক্ত কর কমিশনার (আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট) সেহেলা সিদ্দিকা ও কর অঞ্চল-২ এর কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদ।
সেহেলা সিদ্দিকা পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদও ঐক্য পরিষদের সদস্য।
এসব বিষয়ে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘এনবিআর চেয়ারম্যান ও অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি দিতে যাচ্ছি- পরিস্থিতি যেন আরও খারাপ না হয়। অসৎ কর্মকর্তাদের বাদ দিতে হবে, তবে আগে কাঠামোগত সংস্কার দরকার।’
জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘এনবিআরের অনেক কর্মকর্তার বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক। চলমান অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দুদক এই অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে সরকারের কোনো চাপ নেই।’



