
প্রিন্ট: ২৮ জুলাই ২০২৫, ০৭:৪৬ পিএম
অনিয়মে বেড়েছে খেলাপি ঋণ, তারপরও বহাল যমুনার এমডি

অনলাইন ডেস্ক :
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ০৭:৪৫ পিএম

ছবি-সংগৃহীত
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু বড় ধরনের অনিয়মের পরও বেসরকারি খাতের যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমডি মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ টিকে গেছেন। ব্যাংকের কেনাকাটায় অনিয়ম, নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার কমতি সত্ত্বেও ৫ আগস্টের পর তিনি বহাল তবিয়তে আছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এরই মধ্যে ব্যাংকের কেনাকাটায় অনিয়মের বিষয়ে যমুনা ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে। এসব অনিয়ম ঘটেছে গত সরকারের আমলের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ছেলে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. সাইদুল ইসলামের যোগসাজশে, যিনি এখন বিদেশে পলাতক বলে জানা গেছে। তিনি দায়িত্বে থাকাকালে ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, তাজুল ইসলামের ছেলে ও যমুনা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. সাইদুল ইসলাম ২০২৩ সালের আগস্টে এক বোর্ড সভায় প্রভাব খাটিয়ে ১৫ কোটি টাকার আইটির হার্ডওয়্যার ও অন্য সরঞ্জামাদি প্রায় ৯০ কোটি টাকায় ক্রয় দেখান। তিনি বাবার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে জানা গেছে। বিশেষ করে ২০২৩ সালের ১৩ আগস্টের বোর্ড মিটিংয়ে আইটি বিভাগের হার্ডওয়্যারসামগ্রী কেনার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। ওই বোর্ড সভায় সভাপতিত্ব করেন মো.সাইদুল ইসলাম। অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে ওই সভায় আইটিসামগ্রী কেনার বিষয়টি পাস করানোর সঙ্গে ব্যাংকের অন্য দুই পরিচালক এবং আইটি বিভাগের প্রধান জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
আইটিসামগ্রী কেনার অভিযোগের ব্যাপারে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক স্বাক্ষরিত চিঠি দুর্নীতি দমন কমিশনে গেলে বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ চিঠির আলোকে দুদকের মহাপরিচালককে (মানি লন্ডারিং) কমিশনের ব্যাংকিং শাখা হতে অনুসন্ধান-পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকিং সূত্র জানিয়েছে, যমুনা ব্যাংকের এমডি নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোনো ব্যাংকের এমডি হতে পারবেন না। কিন্তু যমুনা ব্যাংকের বর্তমান এমডি মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ শিক্ষাজীবনে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণিপ্রাপ্ত। এর পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে তাকে আরও পাঁচ বছরের জন্য এমডি হিসেবে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের এক তদন্তে এমন অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। এ ছাড়া তার বেতন-ভাতা বাবদ পরিচালিত ব্যাংক হিসেবেও আর্থিক লেনদেনে অনিয়ম পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব অনিয়মের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে বলা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মির্জা ইলিয়াছ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৮৫ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডে কর্মজীবন শুরু করেন। এর পর তিনি প্রাইম ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে যমুনা ব্যাংকে এসএভিপি হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০১৩ সালে একই ব্যাংকে ডিএমডি এবং ২০১৬ সালে এএমডি হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর ব্যাংকটির এমডি ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৯ সালে যখন তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়, সেই সময়েও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম না মেনেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কারণ ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের এমডি নিয়োগসংক্রান্ত এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়েই তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি গ্রহণযোগ্য হবে না। সম্প্রতি এমডি নিয়োগের নতুন একটি নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নীতিমালায়ও একই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর এমডি পদে মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদের প্রথম দফার নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়। দ্বিতীয় দফায় নিয়োগের জন্য গত ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদের নাম সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন চাওয়া হয়। পরে তাকে পাঁচ বছরের জন্য এমডি হিসেবে পুনর্নিয়োগের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যাংকের পাশাপাশি নিজেদের তৈরি করা নির্দেশনাও ভঙ্গ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবশ্য দ্বিতীয় মেয়াদে এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর সুপারিশ ছিল বলে জানা গেছে।
এদিকে যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পরিচালিত ব্যাংক হিসাবেও অনিয়ম পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, যমুনা ব্যাংকের এমডির বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ব্যাংকটির দিলকুশা শাখায় একটি হিসাব পরিচালিত হয়। এতে ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেতন-ভাতা ও অন্য সুবিধার অর্থ হিসাবটিতে জমা হওয়ার পাশাপাশি নগদ এবং অন্য ব্যাংক থেকে অনলাইন ট্রান্সফারের মাধ্যমে প্রায় ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এ অর্থের কোনো উৎস খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, বর্তমান এমডির আমলে খেলাপি ঋণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের তুলনায় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৪৪১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৯৬০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা হয়েছে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ।
জানা যায়, ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০ কোটি ৬৯ লাখ টাকার খেলাপিযোগ্য ঋণকে গত বছরের জুনের মধ্যে নিয়মিত করার শর্তে অশ্রেণিকৃত রাখা হয়। তবে এ সময়ের মধ্যে ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় নতুনভাবে ১৮৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকার ঋণ খেলাপি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল। সূত্র অনলাইন