
প্রিন্ট: ০১ জুলাই ২০২৫, ১২:০৮ এএম
শেরপুরের বিলুপ্তির পথে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের তাঁতশিল্প

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৫, ১১:৩৬ এএম

বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকার তাঁতশিল্প। একসময় গারো পাহাড়ের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পল্লিতে দিন-রাত এসব তাঁতের খটখট আওয়াজ পাওয়া গেলেও এখন সে শব্দ তো দূরের কথা, তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগর ও তাঁতের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই ভার হয়ে উঠেছে। গ্রামগুলোয় ধ্বংসস্তূপের মতো পড়ে থাকতে দেখা যায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যের ধারক-বাহক তাঁত মেশিনগুলো।
একসময় এ এলাকার গারো, কোচ, ডালু, বানাই, হদি, বর্মণসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিজেরাই তৈরি করে ব্যবহার করত। যাদের তাঁত ছিল না তারা গ্রামের ওইসব তাঁতের তৈরি করা গামছা, লুঙ্গি, মেয়েদের ওড়না, দক শাড়ি, দক মান্দা, বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন পোশাক কিনে ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন সে ঐতিহ্য হারিয়ে তারা প্রচলিত পোশাক পরতে বাধ্য হচ্ছেন।
সূত্র মতে, শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদীসহ জেলার সদর ও নকলা উপজেলা মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সদস্যের বসবাস। এর মধ্যে পাহাড়ি এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শত শত বছর ধরে তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখে নিজেদের পোশাক নিজেরাই তৈরি করে ব্যবহার করে আসছিল। কিন্তু জীবন-জীবিকার তাগিদে এসব তাঁতশিল্প ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাওয়ায় ও সুতার মূল্য বৃদ্ধিসহ নানা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে এ এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বিশেষ করে গারো ও কোচ সম্প্রদায়ের মানুষ প্রায় আট থেকে ১০ বছর আগেই তাদের সে ঐতিহ্যের তাঁত বন্ধ করে দেয়। ফলে গারো ও কোচ সম্প্রদায়ের বাড়িতে ঘুণ ধরা কাঠের তাঁতগুলো এখন পড়ে আছে।
তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনও তাদের এ ঐতিহ্য এবং শিল্পকে রক্ষা করতে হলে সরকারের সুদৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। অবশ্য অনেক আগেই এ শিল্পের কারিগররা অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। অনেকে কাজের সন্ধানে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছেন।
ঝিনাইগাতী উপজেলার রাংটিয়া কোচপাড়ার জাগেন্দ্র কোচ বলেন, ‘আট বছর আগে আমার আটটি তাঁত ছিল। আমরা গামছা, লুঙ্গি, নারীদের ওড়না, শাড়ি, বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন পোশাক বুনতাম। কিন্তু সুতার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমাদের অনেক খরচ পড়ে যেত। শ্রমিকরাও তাদের মজুরিতে না পোশানোয় তারা অন্য পেশায় চলে যান। আবার টেক্সটাইলের শাড়ি-লুঙ্গির দাম অনেক কম থাকায় আমাদের গোত্রের লোকজন সেই পোশাকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে আমাদের এ তাঁত আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়।’ জীবিকার তাগিদে খরচ বাঁচাতে তাঁত বন্ধ করতে হয়েছে বলে জানান তিনি।
একই গ্রামের তাঁত শ্রমিক প্রণব কোচ বলেন, ‘আমি তো অনেক আগেই ঢাকায় একটি হোটেলে বাবুর্চির চাকরি করছি। এলাকার তাঁতগুলো আবারও চালু হলে ঢাকায় আর থাকতাম না।’ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারী রায়তি কোচ বলেন, ‘আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী দক শাড়ি পরা বাদ দিয়ে বাঙালিদের শাড়ি পরতে বাধ্য হইছি। এহন এ তাঁত চালু হইলে আমগো ভালো হইতো।’
এ বিষয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোচ নেতা যোগেন কোচ বলেন, ‘আমাদের ঐতিহ্যের তাঁত ও পোশাক রক্ষায় একসময় কারিতাস কিছু সহযোগিতা করলেও এখন আর কেউ খোঁজ নিচ্ছে না। তবে সরকার থেকে কোনো সহযোগিতা পেলে আবার আমাদের এ ঐতিহ্য ফিরে আসতে পারে। ইতোমধ্যে দেশের পার্বত্য এলাকার চাকমা ও মণিপুরি তাঁত সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থার সহযোগিতায় বিলুপ্তের হাত থেকে বেঁচে উঠেছে। আমরাও চাই আমাদের শেরপুরের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রতি সরকার-বেসরকারি কোনো সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক।’
জানতে চাইলে শেরপুর বিসিক শিল্প নগরীর কর্মকর্তা এসএম রেজুয়ানুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ঐতিহ্য ও তাঁতশিল্পের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করব। তারা যদি তাদের এ শিল্পকে রক্ষায় আমাদের কাছে আসে তাহলে আমরা বিপণন ও ঋণ সহায়তা দিতে পারব।’