
প্রিন্ট: ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩৮ এএম
এখনও বদি সিন্ডিকেটের দখলে সীমান্ত চোরাচালান ও হুন্ডি নেটওয়ার্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ মে ২০২৫, ১২:৪০ এএম

আবদুর রহমান বদি
২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়া অঞ্চলে শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন আবদুর রহমান বদি। সময়ের সাথে সাথে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় গড়ে ওঠে একটি বিশাল অবৈধ সিন্ডিকেট, যার কেন্দ্রে ছিলেন এই সাবেক সংসদ সদস্য। ইয়াবা, মানবপাচার, হুন্ডি এবং সীমান্ত চোরাচালান—সব ক্ষেত্রেই এই চক্রের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ ছিল স্পষ্ট।
এই চক্রের অস্তিত্ব কোনো গুজব নয়—প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক গোপন প্রতিবেদনে বদির নাম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও ‘গডফাদার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার হন আবদুর রহমান বদি এবং বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু তাতেও থেমে নেই মিয়ানমারকেন্দ্রিক হুন্ডি ও চোরাচালান কার্যক্রম। কারাগারে থেকেও বদি এবং তার ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান ও আত্মগোপনে থাকা ছেলে শাওন আরমানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে সিন্ডিকেটটি সক্রিয় রয়েছে। রাজনৈতিক মোড়ক পাল্টে এখন অনেকে বিএনপি ও জামায়াত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১৫ বছরে গড়ে ওঠা এই হুন্ডি সিন্ডিকেটের সাথে বদির সরাসরি ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এর নেতৃত্বে রয়েছে টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা এবং দুবাই প্রবাসী জাফর আহমদ ওরফে ‘টিটি জাফর’। তিনি বিদেশ থেকে বাংলাদেশে হুন্ডি লেনদেনের নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছেন। চট্টগ্রামের কারাগারে বদির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ও টেকনাফে বৈঠক এই অভিযোগকে আরও জোরালো করে।
টেকনাফের নিউ মার্কেট এলাকায় অবস্থিত ‘টিটি অফিস’ নামক একটি অভিজাত কার্যালয় থেকেই এই হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালিত হয়, যার দেখভাল করেন জাফরের বড় ভাই সাবেক কাউন্সিলর মানিরুজ্জামান, শ্যালক কোরবান আলী ও সিরাজ মিয়া। চট্টগ্রামে এই সিন্ডিকেটের শাখা অফিসগুলো পরিচালনা করছেন হুন্ডি ওসমান ও রমজান আলী নামক দুই সহযোগী।
সিন্ডিকেটের আরেক মুখ্য সদস্য ‘সিআইপি ফারুক’ নামে পরিচিত ওমর ফারুক, যিনি বদির সৎ বোনের জামাই। তিনি চট্টগ্রাম থেকে এই সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন এবং নিয়মিত কারাগারে বদির সাথে সাক্ষাৎ করে তার নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্তত ২০ জন সদস্য টেকনাফে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। ফারুকের ভাই এনামুল হাসান, যিনি একসময় বদির ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন, বর্তমানে বিএনপির নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।
সিন্ডিকেটের অংশ হিসেবে যাদের নাম উঠে এসেছে তারা হলো—টেকনাফের কুলালপাড়ার জাহাঙ্গীর আলম, তার ভগ্নিপতি রকিবুল হাসান ও আবদুর রহমান। এরা ফার্মেসির আড়ালে হুন্ডি চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও অভিযুক্তরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তালিকায় আরও আছেন—আব্দুর হাই, মো. ইয়াসিন, মো. ইব্রাহিম, বর্মাইয়া আলী, আয়াছ, ইয়াছের, আবু বক্কর, আবুল ফয়েজ, মো. দেলোয়ার, মো. শফিক, মো. শামসু, শফিক উল্লাহ, ডালিমসহ অন্তত আরও ১০-১২ জন স্থানীয় যুবক। যারা বদির আত্মীয়স্বজনের হয়ে সীমান্তে চোরাচালান ও মাদক পাচারে যুক্ত।
বদির ছেলে শাওনের হয়ে ব্যবসা দেখাশোনা করছেন উত্তর জালিয়াপাড়ার বিএনপি নেতা ফরিদ আলম। অন্যদিকে বদির ভাই মুজিবুর রহমানের হয়ে কাজ করছেন ছৈয়দ আলম, যিনি একই ওয়ার্ডের বিএনপির সভাপতি। বদির মালিকানাধীন চৌধুরীপাড়ার গুদামঘর থেকে মিয়ানমারে পণ্য পাঠানোর কাজ চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, সীমান্ত এলাকার দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং প্রশাসনের কিছু সদস্যের দুর্নীতির সুযোগে এই সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে টিকে রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর তারা নতুন রাজনৈতিক পরিচয়ে আরও শক্তিশালীভাবে সংগঠিত হয়েছে।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা জানি কারা জড়িত, কিন্তু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে ব্যবস্থা নিতে পারছি না।”
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দিন জানান, হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে ব্যবস্থা নেয়া হলেও তারা জামিনে বেরিয়ে পুনরায় একই কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
বিজিবির টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আশিকুর রহমান বলেন, “সীমান্ত সুরক্ষায় সর্বোচ্চ নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। হুন্ডি ও মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।”