
প্রিন্ট: ৩০ জুন ২০২৫, ১১:৪৩ পিএম
ভয়াল ২৯ এপ্রিলের ৩৪ বছর : এখনও বেড়িবাঁধ ভাঙ্গনে অনিরাপদ উপকুলের মানুষ

কক্সবাজার প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:০৮ পিএম

ছবি : ভয়াল ২৯ এপ্রিলের ৩৪ বছর : এখনও বেড়িবাঁধ ভাঙ্গনে অনিরাপদ উপকুলের মানুষ
আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল। বাংলাদেশের উপকূলবাসীর স্বজন হারানোর দিন। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের দিবাগত মধ্যরাতে কক্সবাজার, চট্রগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী, রবগুনা সহ দেশের উপকূলীয় এলাকার উপর দিয়ে ১২ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় জ্বলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। এতে ২ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটার পাশাপাশি নিখোঁজ হয় ১ লাখ মানুষ। ৭০ হাজার গবাদী পশু মারা যায়।
স্বজন হারানো মানুষগুলো ৩৪ বছর পরও আতংকে রয়েছেন। কক্সবাজারের উপকুল জুড়ে বেড়িবাঁধের তীব্র ভাঙ্গনের কবলে অনিরাপদ জীবন যাপন করছেন তারা।
কক্সবাজারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, কক্সবাজারের ৫৪৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ৬০ শতাংশই বর্তমানে বেহাল। মহেশখালীতে অন্তত ৬৫ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে গেছে এবং মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে আরও কয়েক কিলোমিটার। বিশেষ করে ধলঘাটা, মাতারবাড়ি ও কুতুবজোমে টেকসই বেড়িবাঁধের অভাব প্রকট রয়েছে।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের চেষ্টা হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বর্তমানে মহেশখালীর ৭০ নম্বর পোল্ডারের বাঁধসহ অনেক বেড়িবাঁধ ভাঙনের কবলে পড়েছে। বর্ষা ও পূর্ণিমার জোয়ারে নিয়মিত প্লাবিত হয় এলাকাগুলো।
ধলঘাটা ইউনিয়নের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা আবদুল করিম বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, বর্ষা মৌসুম এলেই আমাদের দুর্ভোগের শুরু হয়। সামান্য বৃষ্টি হলেই বাঁধ ভেঙে ঘরে পানি ঢুকে পড়ে। ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে খাবার পর্যন্ত ভেসে যায়। একেকটি বর্ষা মৌসুম আমাদের জন্য যুদ্ধের মতো। এখনো সেই দুর্দশা কমেনি। বরং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের তীব্রতা আরও বেড়েছে। সুপার ডাইক প্রকল্পের কথা শুনেছি, যদি তা বাস্তবায়ন হয়, তাহলে হয়তো আমাদের জীবনে কিছুটা স্বস্তি ফিরবে। আর না হলে প্রতি বছর একই দুঃসহ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। আমরা চাই, কর্তৃপক্ষ যেন দ্রুত কাজ শুরু করে, যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্তত নিরাপদে থাকতে পারে।
মাতারবাড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দা রুনা আক্তার বলেন, প্রতিবার বৃষ্টি বা পূর্ণিমার জোয়ারের সময় মনে হয় জীবন যেন হাতের মুঠোয় নিয়ে চলছি। দুশ্চিন্তা আর আতঙ্ক আমাদের নিত্যসঙ্গী। পানি ঢুকে পড়লে ঘরের শিশুরা, বৃদ্ধরা—সবার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই। এই অবর্ণনীয় কষ্টের কোনো শেষ নেই। টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে আমরা প্রতি বছর নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। একটি স্থায়ী এবং শক্তিশালী বেড়িবাঁধ ছাড়া মহেশখালীর মানুষের শান্তি আসবে না। আমরা চাই, 'সুপার ডাইক' প্রকল্প দ্রুত অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন করা হোক। যেন আমরা নিরাপদে বাঁচতে পারি, আমাদের সন্তানরা নির্ভয়ে ঘুমোতে পারে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বারবার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন। ধলঘাটার নুরুল ইসলাম বলেন, "প্রতিবার বর্ষা এলে মনে হয় জীবন হাতে নিয়ে চলছি। বৃদ্ধ সোলতান আহমদ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, "সাগরের সাথে যুদ্ধ করেই বেঁচে আছি। অথচ প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। বাঁধ না থাকায় হাজারো পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে, আর একবার বড় দূর্যোগ এলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা প্রকট।
ধলঘাটা রক্ষা আন্দোলনের নেতা আব্দুল মান্নান বানা বলেন, ‘টেকসই বেড়িবাঁধ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র বৃদ্ধি, দুর্যোগ প‚র্বাভাস উন্নয়ন ও জনসচেতনতা ছাড়া উপকূল সুরক্ষিত রাখা অসম্ভব। শুধু বাঁধ নির্মাণ নয়, বাঁধের পাশে ম্যানগ্রোভ বনায়ন ও বিকল্প জীবিকাও নিশ্চিত করতে হবে। না হলে ৩৪ বছর পরেও মহেশখালী-কুতুবদিয়ার মানুষের জীবন থাকবে অস্তিত্বের হুমকিতে। উপকূলবাসী আজও সেই নিরাপদ জীবনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
মহেশখালীর ধলঘাটা ও মাতারবাড়ি এলাকার জন্য সুপার ডাইক নির্মাণে প্রায় ৩৮০০ কোটি টাকার একটি বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ জামাল মুর্শিদ জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রকল্পটির অনুমোদন মিলতে পারে এবং ২০২৯ সালের মধ্যে মহেশখালীবাসী একটি স্থায়ী ও শক্তিশালী বেড়িবাঁধের সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
তিনি জানান, সর্বশেষ ২০১৮-২০ অর্থবছরে ধলঘাটা ও মাতারবাড়ি এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়েছিল। বর্তমানে দুই ইউনিয়নে মোট ৩২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬.৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বর্তমানে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। প্রায় ৭.৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সড়ক ও জনপথ (সওজ)-এর আওতাধীন এবং বাকি ১৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ স্বাভাবিক ঝুঁকিতে রয়েছে। তিনি বলেন, মহেশখালী একটি দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। টেকসই বেড়িবাঁধ ছাড়া উপকূলীয় জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব নয়। সুপার ডাইক প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ধলঘাটা ও মাতারবাড়ি সহ সমগ্র মহেশখালীবাসী দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা পাবে। পাশাপাশি জীবিকার নিশ্চয়তার পথও প্রশস্ত হবে।
কুতুবদিয়া দ্বীপের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপের ৪০ শতাংশ ভূমি সাগরে বিলীন হয়। বর্তমানে ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে চারটি ইউনিয়ন নিয়মিত জোয়ারে প্লাবিত হয়। দক্ষিণ ধুরুং, বড়ঘোপ ও আলী আকবর ডেইলে বেড়িবাঁধ ভেঙে সাগরের পানি গ্রামে ঢুকে পড়ে। জীবন রক্ষায় স্থানীয়রা বাঁশ ও মাটির বাঁধ দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু তা সামান্য ঢেউয়ের ধাকলেই ভেঙে যায়।
ইতিমধ্যে নতুন করে কুতুবদিয়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙে সাগরের পানি ঢুকছে লোকালয়ে। প্রতিনিয়ত আলী আকবর ডেইল বায়ু বিদ্যুৎ, তেলিপাড়া ও তাবালের চরে কয়েকটি স্থানে ভাঙনের কবলে পড়ে অতিরিক্ত জোয়ারে ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। শুধু আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের ৩টি পয়েন্টে ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ৩০ কোটি টাকার বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প। একই সাথে অতি সন্নিকটে কবি জসীম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের নতুন একাডেমিক ভবনটিও রয়েছে মারাত্বক ঝুঁকিতে।
রিক্সা চালক জসিম উদ্দি ন জানান, কাল সোমবার পূর্ণ জোয়ার শুরু হলে তেলিপাড়া দিয়ে সাগরের পানি ভিতরে প্রবেশ করবে। গত বছরে জরুরি কাজ ফেলে ঠিকাদার লাপাত্তা ছিল বলে জানায় সে। যে কারণে ভাঙন মেরামত শেষ হয়নি।
আশপাশের অন্তত ১০টি গ্রামে লোনা জল ঢুকে অতিরিক্ত জোয়ার হলেই। বিগত সরকারের আমলে সুপার ডাইক বেড়িবাঁধের স্বপ্ন দেখিয়ে উত্তর জোনে কাজ হলেও দক্ষিণজোনে কাজের কাজ কিছুই না হওয়ায় দ্বীপের এক অংশ সাগরে তলীয়ে যাবার উপক্রম এখন।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারি প্রকৌশলী এল্টন চাকমা বলেন, শুধু আলী আকবর ডেইলে নয়, উপজেলার আন্যান্য স্থানের ভাঙা বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করে গেছেন উর্ধতন কর্তৃপক্ষ। জরুরি ভিত্তিতে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা আগে মেরামত করা হবে বলে জানান তিনি।