রাজশাহীতে এইচআইভিতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, ছয় বছরে শনাক্ত ৯৩ জন
রাজশাহী প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৫২ এএম
রাজশাহীতে ক্রমাগত বাড়ছে এইচআইভি (হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) আক্রান্তের সংখ্যা। চলতি বছর (২০২৫) অক্টোবর পর্যন্ত ২৮ জন নারী-পুরুষ ও একজন হিজড়া এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। একই সময়ে এইডসে মারা গেছেন একজন। আক্রান্তদের অধিকাংশের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, যা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উদ্বেগজনক প্রবণতা তৈরি করেছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের তথ্য বলছে, গত ছয় বছরে এ অঞ্চলে এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৯৩ জন, মারা গেছেন আটজন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রাজশাহীতে যৌনকর্মীদের তুলনায় সমকামী সম্পর্কের মাধ্যমেই বেশি ছড়াচ্ছে এইচআইভি সংক্রমণ।
রামেক হাসপাতালের এইচটিসি (এইচআইভি টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সেলিং) সেন্টারে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এখানে পরীক্ষার পাশাপাশি কাউন্সেলিং করা হলেও এখনো ওষুধের ব্যবস্থা নেই। রাজশাহী বিভাগের আক্রান্তদের চিকিৎসা নিতে হয় বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল থেকে, যেখানে বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে রামেকে ৭৭ জনের নমুনা পরীক্ষা হলেও কেউ এইচআইভি পজেটিভ ছিলেন না। ২০২০ সালে দুইজন, ২০২১ সালে আটজন, ২০২২ সালে আটজন, ২০২৩ সালে ২৪ জন, ২০২৪ সালে ২৭ জন এবং ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২৮ জন আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন।
২০২৪ সালে ২৭ জন আক্রান্তের মধ্যে ১৬ জনের শরীরে সমকামী সম্পর্কের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়ায়। যৌনকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটে ১০ জনের, আর একজন রক্তের মাধ্যমে আক্রান্ত হন। একইভাবে ২০২৫ সালে শনাক্ত ২৮ জনের মধ্যে ১৭ জন সমকামিতার মাধ্যমে এবং ১০ জন যৌনকর্মী শ্রেণির মধ্যে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ বছরও একজন রক্ত সংক্রমণে আক্রান্ত হন।
রামেকের এক এইচআইভি পজেটিভ রোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এইচআইভি ধরা পড়ার পর থেকে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু রাজশাহীতে এইচআইভির ওষুধ পাওয়া যায় না, যেতে হয় বগুড়ায়। ওষুধ রাজশাহীতেই পাওয়া গেলে রোগীদের অনেক সুবিধা হতো।
রামেক হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এখানেও একটি এআরটি (অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি) সেন্টার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা চলছে, খুব শিগগিরই তা চালু হলে রাজশাহী ও আশপাশের জেলার রোগীদের আর বগুড়ায় যেতে হবে না।
রামেকের এইচটিসি সেন্টারের কাউন্সেলর রেজাউল করিম বলেন, অনেক রোগী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, আত্মহত্যা বা ভাইরাসটি অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা পর্যন্ত করেন। আমরা তাদের নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সচেতন করি এবং সুস্থভাবে বাঁচার দিকনির্দেশনা দিই।
তিনি জানান, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত (অক্টোবর ২০২৫) রামেকে মোট ১২ হাজার ৪৬৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯৩ জন এইচআইভি পজিটিভ এবং আটজন মারা গেছেন।
রামেক হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারের ফোকাল পার্সন ডা. ইবরাহীম মো. শরফ বলেন, অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ যৌনসম্পর্কই এইচআইভি ছড়ানোর প্রধান কারণ। নারী-পুরুষে বা পুরুষ-পুরুষে যৌনসম্পর্ক ছাড়াও গর্ভকালীন অবস্থায়, জন্মের সময় বা মায়ের দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবার যৌনমিলনের সময় কনডম ব্যবহার করা, একাধিক যৌনসঙ্গী থেকে বিরত থাকা, পরীক্ষা ছাড়া রক্ত সঞ্চালন না করা, ইনজেকশন বা সিরিঞ্জ ভাগাভাগি করে ব্যবহার না করা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলেই এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, তরুণদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষা ও সহজলভ্য চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি— অন্যথায় এইচআইভির সংক্রমণ আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।



