বিষাক্ত বর্জ্যে মরে যাচ্ছে রাজশাহীর বারনই নদী
রাজশাহী প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৩২ এএম
একসময় প্রমত্তা প্রবাহে রাজশাহীর জনজীবন ও কৃষি সেচে প্রাণ সঞ্চার করত বারনই নদী। এখন সেই নদী দূষণে মৃতপ্রায়। রান্না বা গোসলের কাজে ব্যবহৃত নদীর পানি আজ স্পর্শ করতেও ভয় পায় মানুষ। শুষ্ক মৌসুমে পচা পানির দুর্গন্ধে চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে থাকে, প্রায়ই ভেসে ওঠে মৃত মাছ।
পরিবেশবিদদের মতে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) দীর্ঘদিনের অবহেলা এবং অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণেই বারনই নদী আজ একটি বিষাক্ত নর্দমায় পরিণত হয়েছে। এক সময়ের বরেন্দ্র অঞ্চলের ‘লাইফলাইন’ নদীটি এখন জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য সরাসরি হুমকি।
সরকারি তথ্যমতে, নগরীর তরল বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য ১৯৯৪ সালে দুটি খাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় রাসিক। ২০০৮ সালে খাল দুটি চালু হওয়ার পর থেকেই শহরের বাসাবাড়ি, হাসপাতাল, শিল্প কারখানা ও গ্যারেজের অপরিশোধিত বর্জ্য এসব খাল হয়ে রাজশাহীর নওহাটা এলাকায় বারনই নদীতে মিশছে।
স্থানীয় সামাজিক সংগঠন বাঁচার আশা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি মোস্তফা বিজলী জানান, রাজশাহী ও নাটোরের সাত উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ দূষিত পানির সংস্পর্শে এসে চর্মরোগে ভুগছেন। শুধু নওহাটা এলাকাতেই আক্রান্তের সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়েছে।
কৃষকরাও বিপদে। নদীর দূষিত পানি ক্ষতিকর জেনেও বিকল্প না থাকায় কৃষিকাজে সেটিই ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। নওহাটার কৃষক সাইফুর রহমান বলেন, নদীর পানি ক্ষতিকর জানি, কিন্তু বিকল্প নেই। তাই বাধ্য হয়েই এ পানি দিয়ে জমি চাষ করি।
এ দূষণের কারণে নদীর জীববৈচিত্র্যও ধ্বংসের পথে। জেলেরা হারাচ্ছেন জীবিকা। জেলে চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, একসময় নদীতে প্রচুর মাছ ছিল। এখন মাছ পাওয়া যায় না। যে কয়টা পাওয়া যায়, সেগুলোর শরীরেই বিষের গন্ধ। ভালো করে রান্না করলেও সেই দুর্গন্ধ যায় না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, নদী দূষণের প্রধান উৎস হলো গৃহস্থালির পয়োনিষ্কাশন, হাসপাতাল এবং বিসিক এলাকার শিল্প বর্জ্য। হাসপাতালের বর্জ্যে রোগজীবাণু থাকে, যা সরাসরি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। বিসিক এলাকায় প্রায় ২০০টি কারখানা থাকলেও কোনো বর্জ্য পরিশোধনাগার নেই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বারনই নদীর পানি এখন জৈবিকভাবে মৃত। নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা প্রতি লিটারে যেখানে কমপক্ষে ৪.৫ মিলিগ্রাম থাকা উচিত, সেখানে পাওয়া গেছে মাত্র ১.২ মিলিগ্রাম। পানিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক ও ভারী ধাতু (সীসা, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, জিংক) শনাক্ত হয়েছে, যা ফসল ও খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে ক্যানসার ও অঙ্গ বিকল হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়ক তন্ময় কুমার সান্যাল বলেন, আইন অনুযায়ী শিল্প ও পৌর বর্জ্য পরিশোধনের আগে অপসারণ করা নিষিদ্ধ। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
এদিকে রাসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন জানিয়েছেন, কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। একইভাবে, রাজশাহী পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী পারভেজ মাহমুদ জানান, একটি কেন্দ্রীয় পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) জমা দেওয়া হয়েছে।



