ফ্যাসিস্টের আত্মায় জিম্মি কিশোরগঞ্জের প্রশাসন
কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি :
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪২ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
কিশোরগঞ্জে ফ্যাসিস্ট সরকারের কর্মকর্তারা চালাচ্ছেন জেলা প্রশাসনসহ প্রতিটি অফিস। বিগত ১৭ বছর ধরে যারা স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সরকারের গুণগানে লিপ্ত ছিল সেইসব কর্মকতার্রাই দাপটের সাথে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দায়িত্বে কিশোরগঞ্জ জেলা পরিচালনা করছেন। এসব কর্মকর্তাদের তৎপরতা জুলাই বিপ্লবী ও আন্দোলন সমর্থনকারীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি করছে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, আবদুল হামিদ ও আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জেলা কিশোরগঞ্জ। বিগত সৈরাচার হাসিনা সরকারের অনুগত কর্মকর্তাদের এই জেলায় নিয়োগ দেওয়া হতো। এ যেনো রক্ত পরিক্ষার মধ্য দিয়ে আওয়ামী পরিবারের লোকজনকে আসতে হতো এ জেলায়। দেশের দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ খ্যাত জেলা কিশোরগঞ্জ বানিয়েছিল তৎকালীন সরকারের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দরা। হাসিনা সরকারের পতন হলেও পরিবর্তন হয়নি এ জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের এমনকি নতুন যারা নিয়োগ হয়েছে তারাও সৈরাচার সরকারের আর্শীবাদে বিভিন্ন দফতরের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন আর এরাই এখন এজেলার নিয়ন্ত্রক। বর্তমানে ফ্যাসিস্টের দোসরদের অপ-তৎপরতা সাধারণ জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এসব কর্মকর্তা দ্বারা আগামী জাতীয় সংসদ নিবার্চন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কিনা এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সাধারণ ভোটাররা।
অনুসন্ধান ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জে জেলা প্রশাসক হিসেবে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ফৌজিয়া খান। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন-নিরাপত্তা বিভাগের উপ-সচিব পদ থেকে ২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জে ডিসি হিসেবে যোগদান করেন। চাকরির শুরুতে ২৪তম বিসিএস‘র এই কর্মকর্তা ২০০৫ সালের ৩ জুলাই সহকারী কমিশনার হিসেবে চট্রগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে যোগদান করেন। এর দুইদিন পর তিনি জেলা প্রশাসক কার্যালয় চট্রগ্রামে সহকারী কমিশনার হিসেবে পদায়িত হন। পরবর্তী সময়ে তিনি ২০০৮ সালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ফেনীতে যোগদান করেন। ২০০৯ সালে আবারও জেলা প্রশাসক কার্যালয় চট্রগ্রামে চলে আসেন। পতিত হাসিনা সরকারের প্রিয়ভাজন হিসেবে তিনি মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে যোগদান করেন। ২০১০ সালে ক্রিম কর্মক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত ঢাকার দোহার উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে পোস্টিং হয়। পরে অধিকতর যুৎসই এলাকা হিসেবে ঢাকার নিকটবর্তী কেরানিগঞ্জে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে যোগদান করেন। এই দুই স্থানে সাবেক সরকারের প্রিয়ভাজন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি প্রায় দুই বছর চাকরি করেন। পরবর্তীকালে তিনি সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঢাকায় এক বছর ১১দিন চাকরি করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিভাগের অধীনে আড়াইহাজার উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করে এক বছর ১ মাস ২৬ দিন দায়িত্ব পালন করেন। এখান থেকে ২০১৪ সালে প্রেষণে উপ-পরিচালক হিসেবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাউজক) ও পরে আবার প্রেষণে উপ-প্রধান হিসেবে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনে ১৪ জুন ২০১৬ পর্যন্ত মোট দুই বছর ২ মাস ১৯ দিন দায়িত্ব পালন করেন। স্বৈরাচার সরকারের আমলে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে সংযুক্ত হন। ২০১৮ সালের রাতের ভোটে সাধারণ নিবার্চনের পর ফৌজিয়া খান উপ-সচিব হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত হন। ২০১৯ সালে উপ-সচিব হিসেবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে আবারও সংযুক্ত হন। ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল ফৌজিয়া খান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপ-সচিব হিসেবে তিন বছর ৫ মাস ৮দিন দাপটের সাথে দায়িত্ব পালন করে স্বৈরাচার সরকারকে নানাভাবে সহযোগিতা দিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ফৌজিয়ানামা :
২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ৬ মাস আটদিন দায়িত্ব পালনের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম-সচিব হিসেবে তিনি পদোন্নতি পান। তিনদিন জনপ্রশাসনে থেকে আবারও কিশোরগঞ্জ ফিরে এসে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিশোরগঞ্জে ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি নানা অনিয়ম-দুর্নীতিসহ বহুবিধ অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েন। গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে জেলা শিল্পকলায় তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এক সাবেক কমাণ্ডার ২৪ এর আন্দোলনকে কটাক্ষ করে বক্তব্য রেখে বলেন, জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু। এ কথা ছড়িয়ে পড়লে ডিসির পদত্যাগ ও প্রত্যাহারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পরে ডিসি ছাত্রনেতাসহ বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের সন্ধ্যায় নৈশ্যভোজের আয়োজন করে নানাভাবে তার ভুল স্বীকার করে আন্দোলন থেকে ছাত্রদের সরে আসতে বাধ্য করেন। পুরাতন স্টেডিয়ামে স্বাধীনতা মেলায় জামিয়া এমদাদিয়া মাদ্রাসার ছাত্রদের দাওয়াত ও পারফরমেন্স করতে না দেওয়ায় ছাত্ররা ডিসির পদত্যাগের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচির ডাক দেয়। ডিসি আবারও জামিয়া এমদাদিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও বিএনপি-জামাতের নেতাদের কৌশলে বাসায় ডেকে নানাভাবে অনুরোধ ও আবারও ভুল স্বীকার করে মাদ্রাসা ছাত্রদের মানববন্ধন কর্মসূচি বন্ধ করতে সক্ষম হন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি ইটভাটা চালুর সময় ৯০ হাজার টাকা এল-আর ফান্ডে নেওয়া হয়, বিভিন্ন বালুমহাল অর্থের বিনিময়ে ইজারা প্রদান, ইজারার টাকা যথাসময়ে আদায় না করা, ২০২৪ সালে দুগার্পূজায় ১০০ টন চাল আত্মসাৎ, জমি অধিগ্রহনের কোটি কোটি টাকা থেকে ৭% তার এল-আর ফান্ডে নেওয়া ইত্যাদি। এছাড়া তিনি রুটিন ওয়ার্কের বাইরে কোন কাজ না করায় জেলা শহর দিয়ে প্রবাহমান নরসুন্দা নদীর কোটি কোটি টাকা ভূমি বেদখল, নরসুন্দা নদীর মুক্তমঞ্চে পাঁচ শতাধিক দোকান অবৈধভাব দখল করে চাঁদাবাজি,শহরে অসহনীয় যানজট এসব বিষয়ে তিনি রহস্যজনক নিরব ভূমিকা পালন করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ ৫ আগস্টের পর প্রশাসন মুক্তমঞ্চের ৪০০ দোকান উচ্ছেদ করেছিল।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর জেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানকে। ডিসির দায়িত্ব পালনের পাশপাশি জেলা পরিষদও তার নির্দেশনায় চলছে। জেলা পরিষদের প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন (উপ-সচিব) মোছা. মোস্তারী কাদেরী। তিনিও স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের একজন আস্থাভাজন কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রধান নিবার্হী হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে তিনি প্রধান নিবার্হী হিসেবে গাজীপুর জেলা পরিষদের দায়িত্বে ছিলেন। গাজীপুর ও বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলার দায়িত্বে থেকে তিনি জেলা পরিষদের প্রধান নিবার্হী হিসেবে হাসিনা সরকারের অসংখ্য কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন। সরকারের দোসর হিসেবে তিনি নির্বাচনী কাজেও জড়িত ছিলেন। এই সরকারের আমলে ডিসিরা জেলা পরিষদের দায়িত্ব পাওয়ার পর কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থমকে গেলেও তাদের আনন্দভ্রমণসহ অফিস ডেকোরেশনের কাজ থেমে থাকেনি। আওয়ামী সরকারের সময় ২০২১ সালে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষ দুটিকে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের মাধ্যমে দৃষ্টিনন্দন করা হয়। গত ১৮ সেপ্টেম্বর জেলা পরিষদের ডাকবাংলো ও অডিটোরিয়ামে অনলাইন বুকিং সিস্টেম উদ্বোধন উপলক্ষ্যে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহীর কক্ষ সুপরিসর করাসহ পূর্বের ব্যয়বহুল ডিজাইন সরিয়ে নতুন করে জেলা পরিষদকে আবারও দৃষ্টিনন্দন করা হয়। এতে ১২ লাখ টাকা অপচয় হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে ১৮ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানের সভাপতিত্বে অনলাইন বুকিং উদ্বোধন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী।
জেলা পরিষদের এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. মোস্তারী কাদেরী বলেন, নিজেদের টাকায় এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে একাধিকবার ভ্রমণে যাওয়া হয়েছে। তার কক্ষ ও জেলা পরিষদকে ১২ লাখ টাকায় আকস্মিক দৃষ্টিনন্দন করার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলেছে নিজেদের অফিস আগে সাজাতে। তাই অফিস সাজানো হয়েছে। এসব টাকার অনুমোদেন রয়েছে। তাছাড়া সাবেক সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের কাজ করেছি। কোনো সুযোগ নিইনি।
এছাড়াও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া গুলির নির্দেশদাতা ইউএনও বিল্লাল হোসেন এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এনিয়ে ছাত্রজনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নেতৃত্ববৃন্দরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও জেলা প্রশাসনসহ সরকারের দায়িত্বশীল জায়গায় অভিযোগ দিয়েও সুরাহা মিলেনি বরং বীরদর্পে ফ্যাস্টিদের প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের ওপর গুলির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় জনমনে রয়েছে ক্ষোভ। পাকুন্দিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এর নির্দেশনায় নির্বিচারে চালানো গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে শত শত ছাত্র-জনতা। এদের মধ্যে অনেকেই অন্ধ ও পঙ্গু হয়ে গেছেন।
গত (৫ আগষ্ট) পাকুন্দিয়া উপজেলা হল কনফারেন্স রুমে উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে। সে সময় পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিল্লাল হোসেন পক্ষপাত মূলক আচরণ করার অভিযোগ করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেন হামলার নির্দেশ দাতা ইউএনও'র বাধার মুখে জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসের আলোচনা সভা এনসিপি বয়কট করে।
সে সময় পাকুন্দিয়া উপজেলা এনসিপির প্রধান সমন্বয়ক রাজিন সালেহ বলেছিলেন, আমরা জুলাই আন্দোলনে পাকুন্দিয়া নেতৃত্ব দিয়েছি সেসময় পাকুন্দিয়া এই ইউএনও ও এসিল্যান্ডের নির্দেশনায় আমাদের ছাত্রজনতার উপর গুলি ও হামলা করার নির্দেশ দিয়েছিল আবার তারাই বাদী হয়ে ছাত্রজনতার উপর মামলাও করেছে। অথচ ফ্যাসিবাদ সরকার দূর হলেও তারা এখনও বহাল তবিয়তে।
পাকুন্দিয়ায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হিসেবে মো. বিল্লাল হোসেন শেখ হাসিনা সরকার আমলে পাকুন্দিয়া যোগদান করেন। এর আগে তিনি রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৩৫তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়ে মোঃ. বিল্লাল হোসেন চাকুরিতে যোগদান করেন। কিন্তু অদৃশ্য শক্তি আর ডিসির ক্ষমতা বলে তিনিই দায়িত্বে থেকে সৈরাচার হাসিনার সরকারের ঠিকাদারদের প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত ছিলেন।
এই সরকারের আমলে গত জানুয়ারি মাসে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের এলাকা মিঠামইন উপজেলার ইউএনও হিসেবে যোগদান করেন ফ্যাসিস্ট সরকারের আরেক দোসর হিসেবে পরিচিত খান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি জুলাই আন্দোলনের সময় ধামরাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার নির্দেশে পুলিশ গুলি ছুড়লে বহু ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয়। যারা এখনও গুলির ক্ষত নিয়ে বিছানায় কাৎরাচ্ছেন। কয়েকজন মারাও গিয়েছেন। আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার ধাওয়া খেয়ে ইউএনও খান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে বাসভবনে ফেলে নিজে সন্তর্পনে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করেন। পরে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা তার নিদোর্ষ পিতা-মাতাকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে দিয়ে বাসায় অগ্নিসংযোগ করে। এতে ইউএনও’র বাসায় রক্ষিত কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পুড়ে যায়। যা সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়েছিল। পরে ঢাকার জেলা প্রশাসক তার বিরুদ্ধে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন ও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। যদিও তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজ পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি। অথচ সেই খান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন কোনো শাস্তি পাবেন তো দূরের কথা, এ সরকারের আমলে আবারও উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে মিঠামইনে দাপটের সাথে রাজত্ব করছেন।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে মুজিব আলম ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে কিশোরগঞ্জে যোগদান করেন। তিনি আওয়ামী সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে নানা অপকর্মে সাথে জড়িত ছিলেন। জুলাই আন্দোলনের পর আইনমন্ত্রীর সাথে তার ঘনিষ্ঠতার ছবি দিয়ে তার এলাকার লোকজন ফেইসবুকে এই সুযোগসন্ধানী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পোস্ট দেন। তাছাড়াও তিনি এখানে যোগদানের পর শেখ রাসেল স্মৃতি ফুটবল টুনার্মেন্টসহ জেলা প্রশাসনের সহায়তায় শেখ পরিবারের বিভিন্ন ব্যক্তির নামে নানা ক্রীড়া ও খেলাধুলার আয়োজন করেন। এসব অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি স্বৈরাচার হাসিনা সরকারকে উন্নয়নের সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করে নানভাবে সরকারের প্রশংসা তুলে ধরেন। তিনি এখনও দাপটের সাথে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। বিগত শিক্ষক নিয়োগে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের তার ইচ্ছেমতো স্কুলে নিয়োগ দেন। এতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষকরাই বেশি লাভবান হয়েছেন বলে একাধিক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক অভিযোগ করেন।
জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. কামরুজ্জামান ২১ মার্চ ২০১৮ তে কিশোরগঞ্জ জেলায় যোগদান করেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলায় কর্মরত রয়েছেন। তিনিও সাবেক সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ও ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। তিনি সরকারের বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ নানা ভাতা ও অনুদান বিতরণের কাজ দাপটের সাথে পরিচালনা করছেন। তার অধীনস্ত সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মো. আলামিন (বর্তমানে তাড়াইল উপজেলায় কর্মরত) প্রতিবন্ধী ভাতার প্রায় ৮ লক্ষ টাকা উত্তোলনের পর আত্মসাৎ করে ধরা পড়লেও ডিসি বিশেষ সুবিধা পেয়ে সেই কর্মকতার্র বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। বর্তমান ডিসি ফৌজিয়া খানের ঘণিষ্ঠজন হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। এছাড়াও সারা জেলায় অন্তত ২৫ কর্মকর্তা স্বৈরশাসক হাসিনার দোসর হয়েও দাপটের সাথে কিশোরগঞ্জে কাজ করছেন।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেন, যে জায়গাগুলোতে সংস্কারের আলোচনা হওয়া উচিত সেই সেক্টরগুলোকে আলোচনায় একবারেই আনা হয়নি। তারমধ্যে মূল হলো প্রশাসন। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বানাইছে কে? রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল থেকেও বেশি হলো এই প্রশাসন ও পুলিশ। তারাই তাকে ফ্যাসিস্ট বানাইছে। সরকার পরিবর্তন হলেও সরকারের ভেতরে সেই পুরোনো আমলার প্রেতাত্মারাই রয়ে গেছে।
কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম রতন বলেন, বর্তমান জেলা প্রশাসকের সাথে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তার সাথে সাধারণেরা দেখা করতে পারে না। এমনকি শহরের গন্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গও দেখা করতে পারে না। এমনকি ফোনও রিসিভ করেন না। যা জেলাবাসীর জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এমন ডিসি এর আগে কখনও আসেনি।
সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি স্বপন কুমার বর্মণ বলেন, বিগত সরকারের আমলে দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলা,কর্মকর্তা প্রশাসনে রেখে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা? এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসাবে আগামি দিনে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে এই প্রত্যাশা করি।
ডিডি কামরুজ্জামনসহ একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে সাবেক সরকারের নির্দেশনা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে পালন করেছি।
জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানকে অভিযোগ বিষয়ে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।



