জেলা প্রশাসকের উচ্চ প্রশংসায় নারায়ণগঞ্জ বাস চালকরা
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৫, ১০:২১ পিএম
ছবি-যুগের চিন্তা
নারায়ণগঞ্জ জেলার বাস ড্রাইভার আওলাদ হোসেন। সিটি বন্ধন পরিবহনে ঢাকা–নারায়ণগঞ্জগামী বাসে কর্মরত। বৈধ ড্রাইভার হিসেবে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। কিন্তু কখনো ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার পরে কোনো কর্মশালায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি।
আজ বুধবার ( ২০ শে আগস্ট) নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিয়ার উদ্যোগে জেলার ড্রাইভার ও হেল্পারদের দিনব্যাপী ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করে উচ্ছ্বসিত পরিবহন শ্রমিক আওলাদ।
আওলাদ বলেন, ডিসি স্যারের উদ্যোগের কারণে এই প্রথম ড্রাইভার হিসেবে আলাদা পরিচয়পত্র পাচ্ছি, যা আমি কখনো আশা করতে পারিনি।
এছাড়া জেলা প্রশাসক স্যার মালিকদের মাধ্যমে আমাকে নিয়োগপত্রও দিচ্ছেন। এখন আমরা অবসর নেয়ার সময় অন্যান্য চাকরিজীবীদের মতো পেনশন পাবো।
নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র পেলে শ্রমিক হিসেবে আমাদের অন্যান্য অধিকারগুলোও নিশ্চিত হবে বলে আশাবাদী এই ড্রাইভার।
আমি আমার ২৫ বছরের ড্রাইভিং জীবনে এমন ভালো কোনো ট্রেনিং পাইনি। প্রশিক্ষক আমাকে গাড়ি চালানোর সময়ে আচরণগত অনেক বিষয় শিখিয়েছেন, যা আমার অনেক কাজে লাগবে।
উৎসব পরিবহনের আরেক ড্রাইভার মো. নরুল ইসলাম বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স নেয়ার সময় গাড়ি চালাতে পারি কি না, শুধু সেটা দেখা হয়। কিন্তু একজন ড্রাইভার হিসেবে যাত্রীদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে, দিনে সর্বোচ্চ কত ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালানো যাবে—এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখার সুযোগ পাইনি। আজ জেলা প্রশাসক স্যার আমাদের সবাইকে মানবিক ড্রাইভার হতে উৎসাহিত করেছেন।
বিআরটিএ-এর প্রশিক্ষক জাহিদুল ইসলাম বলেন, মানবিক দেশ গড়তে মানবিক ড্রাইভার তৈরি করতে হবে। কারণ সমাজের সর্বনিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তরের নাগরিকদের ড্রাইভারের সার্ভিস নিতেই হয় প্রতিনিয়ত। জননিরাপত্তার জন্য সড়কের নিরাপত্তা আগে জরুরি।
জেলা প্রশাসকের এমন উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেন, একজন মানবিক জেলা প্রশাসক হিসেবে তিনি মানবিক পরিবহন শ্রমিক গড়তে যাচ্ছেন।
ড্রাইভার ও হেল্পারদের নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেয়ার ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম উল্লেখ করে প্রশিক্ষক জাহিদুল ইসলাম আরো বলেন, ডিসি স্যার পরিকল্পনা করেছেন একজন ড্রাইভার বয়স শেষে অবসর নিলে তাদের একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্মান জানানো হবে, যাতে এই পেশার প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।
এছাড়া তিনি ড্রাইভারদের পেনশন দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন বলেও আমাদের জানিয়েছেন। আশা করি নারায়ণগঞ্জ জেলা থেকে শুরু হওয়া এই নতুন উদ্যোগ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের জয়েন্ট সেক্রেটারি মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে আমাদের পরিবহন শ্রমিকরা নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র পাচ্ছেন। এর ফলে মালিকরা সামান্য কারণে পরিবহন শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করতে পারবে না। এছাড়া বছরে দুটি বোনাস পাবে মালিকদের কাছ থেকে।
তিনি প্রতি বছর ড্রাইভারদের কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুরস্কার প্রবর্তনের আহ্বান জানান, যাতে ড্রাইভারদের মধ্যে নিয়ম মানার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকলে সেটাও আমরা একত্রে বসে দূর করব।আমরা নারায়ণগঞ্জ থেকে এই যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করছি।
বাস ড্রাইভার ও হেল্পারদের পোশাক দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা পরিবহন শ্রমিকদের সম্মান বাড়াতে চাই। উনারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন, দেশের ১৮ কোটি মানুষকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিরাপদে নিয়ে যাচ্ছেন—তাদের জীবনপ্রবাহ ঠিক রাখছেন এত চ্যালেঞ্জের মধ্যেও। রাস্তা ভাঙা, প্রচণ্ড যানজট—এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন।
আমরা তাই পরিবহন শ্রমিকদের সেই সম্মানের জায়গায় তুলে ধরতে চাই। আমরা ড্রাইভার ও হেল্পারদের নিয়ে একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করছি। এগুলো বাস্তবায়ন হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক আরো বলেন, নারায়ণগঞ্জের সড়ক পরিবহন খাতকে একটি সুসজ্জিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও আধুনিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করার লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যা সড়কে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করবে।
এর আগে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের আলোচিত গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন নারায়ণগঞ্জ কর্মসূচির আওতায় গ্রিন আমব্রেলার উদ্যোগে মালিক ও ড্রাইভারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে জেলা পরিষদ অডিটরিয়ামে “পেশাদার গাড়ি চালকদের প্রশিক্ষণ, বিশেষ ইউনিফর্ম, নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র প্রদান কর্মসূচি” অনুষ্ঠিত হয়। এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা।
এই কর্মসূচির আওতায় গাড়ি চালক ও হেল্পারদের পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি, পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান, নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম সরবরাহ, নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড প্রদান করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৫টি কোম্পানির ২১৬ জন ড্রাইভার ও ৭৬ জন হেল্পারের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে।
এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, দুর্ঘটনা হ্রাস, পরিবহন খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং মালিক–চালক–হেল্পারদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়ন।
কর্মসূচির প্রথম দিনে মোট ৫৪ জন চালক দিনব্যাপী প্রশিক্ষণে অংশ নেন। পর্যায়ক্রমে জেলার সব বাস কোম্পানির সব চালক ও হেল্পারদের এ কর্মসূচির আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি যাত্রীদেরকেও সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সড়ক ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করা হবে।
অনুষ্ঠানে মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি রওশন আলী বলেন, গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন কর্মসূচির আওতায় ড্রাইভারদের ইউনিফর্ম প্রদান একটি সম্পূর্ণ নতুন ও ঐতিহাসিক উদ্যোগ, যা ডিসি মহোদয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম নারায়ণগঞ্জে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বিশেষ অতিথি সিভিল সার্জন জনাব ডা. এ এফ এম মুশিউর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ জেলা প্রশাসক তার নিয়মিত কাজের গণ্ডির বাইরে গিয়ে শুধুমাত্র জনগণের কল্যাণে বাস্তবায়ন করছেন।
অনুষ্ঠানের সভাপতি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, এই কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের পাশাপাশি ড্রাইভারদের কাজের স্বীকৃতি ও সম্মান বৃদ্ধি পাবে। সড়কে দুর্ঘটনা রোধের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ জেলা প্রশাসক মহোদয়ের স্বপ্ন ছিল, যা আজ তাঁরই হাত ধরে নারায়ণগঞ্জে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।



