Logo
Logo
×

রাজধানী

বিমান বিধ্বস্ত : প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষকের বর্ণনা

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক :

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৫, ১০:৪৮ এএম

বিমান বিধ্বস্ত : প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষকের বর্ণনা

ফাইল ছবি

স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। দোতলায় আমার সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে সাত-আটজন বাচ্চা ছিল। বেশির ভাগই অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। হঠাৎ বিকট শব্দ। প্রথমে ভেবেছি বজ্রপাতের শব্দ। কিন্তু আকাশ তো পরিষ্কার, সেটা তো হওয়ার কথা নয়। এরই মধ্যে পাশের নারকেলগাছে আগুন জ্বলতে দেখা গেল। কী ঘটেছে, ভাবতে ভাবতেই দোতলার বারান্দাসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন ছড়াতে লাগল। ধোঁয়ায় দমবন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা।

মি যে কক্ষটায় ছিলাম, সেটি ভবনের পশ্চিমদিকে। শেষ মাথায় ওয়াশরুম। কক্ষে টেকা কঠিন হয়ে পড়লে প্রথমে বাচ্চাদের নিয়ে ওয়াশরুমে আশ্রয় নিলাম। এর মধ্যে হঠাৎ মাথায় এলো, এই পাশটায় বারান্দার শেষ মাথায় একটি ছোট লোহার পকেট গেট আছে। অবশ্য সেটি সব সময় তালা দেওয়া থাকে। সেদিনও তালা দেওয়া ছিল। তবে গেটের লোহা কিছুটা চিকন। ভাবলাম, দেওয়াল তো আর ভাঙা যাবে না। গেটটা ভাঙতে পারলে বাঁচতে পারব। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে শেষ চেষ্টা আর কি! নিজের সন্তানের বয়সী ছাত্ররা ভয়, আতঙ্কে কুঁকড়ে গেছে। তাদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। শুধু বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল।

কীভাবে গেট ভাঙব, মাথায় আসছিল না। কয়েকটা লাথি দিয়েও কাজ হলো না। হঠাৎ দেখি বারান্দা দিয়ে দৌড়ে একটি ছেলে আমার দিকে আসছে। তার শার্টে আগুন। স্যার, আমাকে বাঁচান বলে আকুতি জানাল। আমি যখন তাকে ধরলাম, তখন আমার হাতও পুড়ে যাওয়ার জোগাড়সময় ঘনিয়ে আসছিলততক্ষণে আগুন আর ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে পারছি নাআমি তখন ওয়াশরুমে থাকা ছেলেদের বললাম, গায়ে আগুন নিয়ে আসা ছেলেটিকে তোমরা পানি ঢালোআমি এদিকে পকেট গেটটা ভাঙার চেষ্টা করি

গেটটা ভাঙতে আমি ক্রমাগত লাথি মারতে থাকি। কতক্ষণ আর কত জোরে আমি লাথি দিয়েছি, তা এখন আর মনে নেই। শুধু ভাবছিলাম, যে করেই হোক গেটটা ভাঙতে হবে। একপর্যায়ে কয়েকটি চিকন লোহা ভেঙে এবং বাঁকা করে একটা শরীর ঢোকানোর মতো ফাঁকা করা গেল। গেটের লাগোয়া ছিল একটি আমগাছ। সেটা ধরে নিচে নামে দু-একজন। এর মধ্যে বাইরে থাকা লোকজন আমগাছে উঠে সবাইকে নামায়। বিকট শব্দ, ছাত্রদের ওয়াশরুমে নেওয়া, গেট ভাঙাসব মিলিয়ে সম্ভবত মিনিট তিনেক সময়। এ সময়টুকুই তখন অনন্তকাল মনে হচ্ছিল।

নিচে নেমে প্রথমবার বুঝতে পারি যে আমাদের ভবনে বিমান আছড়ে পড়েছে। এর আগে বিমান দুর্ঘটনার কথা মাথাতেই আসেনি। আমার মনে হয়েছে, বিমানের যে ইঞ্জিনের শব্দ, সেটা ছিল না; বরং আছড়ে পড়ার পর দুবার বিকট শব্দ শুনেছি। প্রথমবার আছড়ে পড়ার। দ্বিতীয়বার মনে হয় জ্বালানির বিস্ফোরণ।

স্কুলের যে দোতলা ভবনে বিমানটি আছড়ে পড়ে, সেটির নিচতলায় বাংলা ভার্সনের ক্লাস হয়। দ্বিতীয় তলায় ইংরেজি মাধ্যমের। আমি যে তলায় ছিলাম, সেখানে সিঁড়ির দুই পাশে ১২টি কক্ষ। এক পাশে মেয়েদের শ্রেণিকক্ষ, অন্য পাশে ছেলেদের। এর বাইরে ল্যাবরেটরি, শিক্ষক কক্ষ আছে। বিমানটি আঘাত হানে ঠিক সিঁড়ি বরাবর, নিচতলায়। এরপর দ্রুত সর্বত্র আগুন ছড়ায়। বেলা একটার দিকে স্কুল ছুটি হয়েছেরীতি অনুযায়ী, প্রথমে মেয়েরা নেমে যায়এরপর ছেলেদেরও বেশির ভাগই নেমে গিয়েছিলযেখানে বিমানটি আঘাত হানে, এর কাছাকাছি দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষে একজন শিক্ষককয়েকজন ছাত্র ছিল। তাদের কক্ষে সবার আগে আগুন পৌঁছায় বলে জেনেছি।

আমি নিচে নেমে দেখলাম দুটি লাশ পড়ে আছে। তবে দেহ ছিন্নভিন্ন। নিজেকে সামলে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। বাচ্চাদের অবস্থা কেমন, তা তো বোঝাই যায়। নিচে নামার পর নিচতলা থেকে দৌড়ে একটা মেয়েকে বের হতে দেখলামতার পরনে ছিল বোরকা, তাতে আগুন।

আমার সঙ্গে যে ছেলেগুলো ছিল, তাদের সবাই নিরাপদে বের হতে পেরেছে। তবে ধোঁয়া, আগুনের তাপে নিশ্বাসে সমস্যা হয়েছে। নামার সময় সামান্য আহত হতে পারে। শুনেছি, গায়ে আগুন নিয়ে যে ছেলেটি দৌড়ে এসেছিল, সে-ও বেঁচে আছে। হাসপাতালে ভর্তি।

বাচ্চারা পকেট গেট দিয়ে যখন বের হয়, তখন আগুন খুব কাছাকাছিআমরা সাধারণত ৪০ ডিগ্রি বা এর বেশি তাপমাত্রা হলেও সাময়িক সময়ের জন্য সহ্য করতে পারিকিন্তু সেখানে যে তাপমাত্র তৈরি হয়েছিল, তা সহ্যের বাইরে ছিল। এর সঙ্গে ধোঁয়া মিলে অসহনীয় অবস্থা। আর দু-এক মিনিট আটকে থাকলে হয়তো বেঁচে ফিরতে পারতাম না। বাচ্চাগুলোর কী হতো, তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠেচোখের সামনে সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীরা পুড়ে মারা গেছে। অনেকেই হাসপাতালের শয্যায় কাতরাচ্ছে। সহকর্মী শিক্ষকও মারা গেছেন। আহত হয়ে জীবন বাঁচাতে লড়ছেন অনেকে। এ এক বিভীষিকা। এমন দিন দেখতে হবে, তা কোনোদিন ভাবিনি। যে ফুলগুলো ঝরে গেছে, তাদের আমরা ফিরে পাব না। যারা বেঁচে আছে, তাদের যেন সৃষ্টিকর্তা ফিরিয়ে দেনএই প্রার্থনাই করছি।


Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন