শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

৩০০ শয্যা হাসপাতাল : বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী, নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা

প্রকাশিত: ২২ আগস্ট ২০১৯  

স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪) : গত পাঁচদিন যাবৎ খানপুর হাসপাতালের ২৩ নং ওয়ার্ডের বিছানায় শুয়েই দিন কাটছে লামিয়ার। মা মর্জিনা বেগমের সাথে ইশারায় কথপোকথন চলছে। দেখে বোঝা গেল বাইরে যেতে চাইছে। কিন্তু শারীরিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় তার ইচ্ছায় বাদ সাধছে মা।

 

কথা হয় মর্জিনা বেগমের সাথে। তিনি জানান, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে  গত রোববার খানপুর হাসপাতালে ভর্তি করায় মেয়েকে। পরে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারে ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে। তারপর থেকেই হাসপাতালে ভর্তি।

 

মর্জিনা বেগম বলেন, আল্লাহ্ আমার মেয়েকে মাফ কর। কথা বলতে না পারায় নিজের সমস্যাগুলোও কারো কাছে বলতে পারে না। রাতে রাতে জ্বর আসছে। গায়ে হাত দেয়া যায় না তখন। ডাক্তার এসে রক্ত পরীক্ষা দিয়ে গেছে। এখন যাব রক্ত পরীক্ষা করাতে।

 

পাশের বিছানায় হাতে ক্যানেলা লাগিয়ে শুয়ে আছে ১০ বছরের বয়সী নাঈম। রক্ত পরীক্ষায় ফলাফল ঠিকঠাক থাকলে আজই মায়ের সাথে বাড়ি ফেরার কথা তার। মা শামীমা বেগম বলেন, গত এক সপ্তাহ আগে প্রচন্ড জ্বর হলে হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরে রক্ত পরীক্ষা করালে ডেঙ্গু ধরা পড়লে হাসপাতালে ভর্তি করাই। গত তিনদিন যাবৎ পাঁচ বছরের মাইয়ারে রাইখা এইখানে পড়ে আছি। এখন রক্ত পরীক্ষায় সব ঠিকঠাক থাকলে আজই বাড়ি চইলা যাব।

 

গত এক মাসের পরিমংখ্যান অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালের ২৩ নং ওয়ার্ডে (শিশু ওয়ার্ড) ভর্তি হয়েছে ২০-২৫ জন শিশু। এমনটাই জানালেন এ ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষরা। বর্তমানে এ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছে ২ জন। বাকিরা সকলেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।

 

এদিকে হাসপাতালের ২২ নং ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় রোগীদের ভীড়। বিছানা না পেয়ে অনেকেই ফ্লোরেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত দু’দিনে এ  ওয়ার্ডে  ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ১৪জন।

 

২২ নং ওয়ার্ড ঘুরে কথা হয় কয়েকজন রোগীর সাথে। মঙ্গলবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে বন্দরের চিতাশাল  এলাকার বাসিন্দা সুমি। সুমির মা মোরশেদা খাতুন জানান, রোগী বেশি হওয়ায় নিচেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। রোগী কিছুটা কম হলে বৃহস্পতিবার সকালে বেডে নেয়া হয়।

 

একই ওয়ার্ডে  ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে গলাচিপা এলাকার রাজ। রাজের মা নুসরাত জাহান নিপা জানান, রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লে গতকাল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসা চলছে।

 

এ বিষয়ে ওয়ার্ডের দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বললে তারা জানায়, বৃহস্পতিবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ২ জন। আরো ৭ জন ভর্তি হয়েছে জ্বর নিয়ে। রক্ত পরীক্ষা করতে দেয়া হয়েছে। এখন ফলাফল আসলেই বলা যাবে কারা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত।

 

২১ নং ওয়ার্ডে ঢুকতেই চোখে পড়ে মশারী টানানো একাধিক রোগী। কথা হয় বন্দর কলাগাছিয়া এলাকার খোরশোদা বেগমের সাথে। জা‘র মেয়েকে নিয়ে দু’দিন যাবৎই হাসপাতালে দিন কাটছে।

 

একই ওয়ার্ডে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জের ঢাকেশ্বরী এলাকার ঝর্ণা। গতকালই ডেঙ্গু জ্বর ধরা পড়ে তার। রাতে ১লাখ ৭হাজার প্লাটিলেট নিয়ে ভর্তি হলেও সকালে এ প্লাটিলেট দাড়িয়েছে ১লাখ ৭০ হাজারে। ঝর্ণা জানান, এখন কিছুটা সুস্থ। তবে খাওয়া দাওয়া করতে কষ্ট হচ্ছে।

এ ওয়ার্ডে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ৩২ জন। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত  ৬ জনসহ আগস্টে ভর্তি হয়েছে ২৫ জন।

 

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়,  গত জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে আগস্টের ২১ তারিখ পর্যন্ত  ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয় ১৮২ জন। এর মধ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে ৮ জনকে। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে ১২২ জন।

 

প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নতুন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে। গত আগস্টে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ১৫২ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ১০১ জন। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছে ৫১।

 

ডেঙ্গু রোগীদের জন্য জুলাই মাসের ২৭ তারিখ থেকে  খানপুর হাসপাতালে ২১,২২,২৩ নং ওয়ার্ডে চালু করা হয় ডেঙ্গু কর্ণার। ডেঙ্গু কর্ণার চালু  করা হলেও চিকিৎসার মান নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ খানপুর হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক  একাধিক রোগীর জানান, ডেঙ্গু রোগীদের জন্য চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থা করা হলেও এর অবস্থা খুবই নাজুক । কিছু দিন বিনামূল্যে ডেঙ্গুর এনএস পরীক্ষা করানো হলেও এখন তা বন্ধ। রক্ত পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে হয় বাইরে থেকেই। গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।

 

এক রোগী জানান, এ পর্যন্ত তিনবার রক্ত পরীক্ষা করিয়েছে। সবগুলোই মর্ডাণ ডায়গণস্টিক সেন্টার থেকে। এখানে কেন পরীক্ষা করানো হচ্ছে না জানতে চাইলে রোগী জানান, এখানকার নার্সরাই বলে যে বাইরে থেকে করানোর জন্য। এখানে রক্ত পরীক্ষা করালে নাকি সঠিক ফলাফল পাওয়া যায় না। তাছাড়া ডেঙ্গুর এনএস ১ পরীক্ষা শুরু হলেও কার্যক্রম এখন বন্ধ ।

 

জানা যায়, সোমবার থেকে পরীক্ষাটি বন্ধ হয়ে পড়ায় রোগীদের ছুটতে হচ্ছে বাইরের ডায়াগনষ্টিক সেন্টারগুলোতে। এনএস ১ নামের পরীক্ষায় সহজেই ডেঙ্গু শনাক্ত করা যায়। শরীর থেকে রক্ত নিয়ে এই পরীক্ষা করা হয়। রাসায়নিক ব্যবহার করে রক্তে ডেঙ্গুর ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। রক্ত নেওয়ার চার থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল জানানো সম্ভব। সম্প্রতি শহরের খানপুরে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে বিনামূল্যে এনএস ১ নামের পরীক্ষাটি চালু হয়। তবে কয়েকদিনের ব্যবধানে কীট (উপাদান) শেষ হয়ে পড়ায় বিনামূল্যের এনএস ১ পরীক্ষাটি বন্ধ হয়ে যায় । তাই রোগীদের টাকা দিয়ে বাহির থেকে পরীক্ষাটি করাতে হচ্ছে।

 

অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স জানান, হাসপাতালে রোগীর তুলনায় আমাদের জনবল খুবই কম। আর রক্ত পরীক্ষার  বিষয়টি যদি বলি এখানে রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আর লোক না থাকায় রক্ত পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না। এছাড়া বিনামুল্যে ডেঙ্গুর এনএস-১ পরীক্ষাটির উপাদানটি শেষ হয়ে গেছে। তবে শীঘ্রই উপাদানটি আনা হবে।

 

নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট খানপুর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবু জাহের জানান, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের জন্য হাসপাতালে আলাদা কর্নার খোলা হয়েছে। আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। যদিও আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে। পর্যাপ্ত লোকবল নেই । এছাড়া আনুসাঙ্গিক  ব্যবস্থাতেও কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। সেখানে তাদের যথাযথ পরিচর্যার মধ্যে রাখা হয়েছে। প্রতিদিনই নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে।  তবে আগের অধিকাংশ রোগীই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। আমাদের চিকিৎসকরা তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। যে সকল ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে আমরা তা পূরণের চেষ্টা করছি।

এই বিভাগের আরো খবর