শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

রাজনীতির মত পবিত্র শব্দ রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারাই কলুষিত

প্রকাশিত: ১৬ মে ২০১৯  

রাজনীতির মত পবিত্র শব্দ রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারাই কলুষিত হচ্ছে। সাধারণ জনমনে এত বাজে বলে এটি বিস্তার লাভ করেছে- কেউ যদি কাউকে ধোকা দেয়, আর যে ধোকার স্বীকার হয় তাকে বলেন- এই মিয়া! আমার সাথে পলেটিক্স করতে এসেছো ? বুঝতেই পারছেন অবস্থাটা কি দাঁড়িয়েছে। একশ্রেণির নামধারী রাজনৈতিক নেতাদের কারণেই রাজনীতির মত পবিত্র শব্দটি দিন দিন কলুষিত হয়ে উঠছে। ভাল মানুষেরা রাজনীতি করেনা- এমন একটি ধারণা সাধারণ জনগণের একটি বড় অংশই বিশ্বাস করেন।

 

রাজনীতি গণমানুষের কল্যাণসাধন এবং দেশের উন্নয়ন ও সাফল্যের জন্য যদি না হয় তাহলে জনগণ এমন ধারণা করবে এটাই স্বাভাবিক। একটা কথা প্রায়ই নেতাদের মুখে শোনা যেত ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়, এখন বাস্তবে এর উল্টোটাই পরিলক্ষিত হয়। নীতি বর্জিত নেতার কোন মূল্য নেই। জনগণের মঙ্গলের জন্য জনপ্রতিনিধি কাজ করেন। সেইসব জননন্দিত নেতার অভাব নেই। ইতিহাসের পাতায় পাতায় চোখ বুলালেই অনেক নেতার নাম ভেসে উঠে। তাদের নামের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তির কমতি নেই।

 

কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে হাতেগোনা গুটি কয়েকজনের নাম খুঁজে পাওয়া যাবে। মুক্তা সমৃদ্ধ ঝিনুক যেমন গভীর জলের অতলে লুকিয়ে থাকে। ঠিক তেমন আজকের সমাজে অনেক সৎ নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক ব্যাক্তি সমাজে লুকিয়ে রয়েছেন। তারা ‘হামকে বড় কোন হে’ নেতার দলে আত্মপ্রকাশ করছেন না। কচুরীপানার ন্যায় প্রচুর নেতার নাম এখন গ্রামে-গঞ্জে ছেঁয়ে গেছে। বড় বড় নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে পাতি নেতারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাঁদাবাজির মহোৎসবে মেতে উঠেছে। নেতাকে মানুষ ভালবাসে না, ভালবাসে নেতার নীতিকে। যিনি জনগণের কল্যাণে কাজ করেন, সেই হচ্ছেন প্রকৃত নেতা। সেই নেতার রাজনৈতিক আদর্শ বুকে ধারণ করে জনগণ।

 

বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, খেয়াঘাট, বালু উত্তোলন, ঝুট, পরিবহন সেক্টর, ব্যাংক, শিক্ষা, চিকিৎসা সেবার নামে চলছে দারুণ দুর্নীতি। বলবেন যাদের উপর এ গুরু দায়িত্ব তাদের মধ্যেই কেউ না কেউ দুর্নীতির জলে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে। সর্ষেতে যদি ভুত থাকে তবে ভুত তাড়াবে কে ? 

 

বিশাল ভোটের যুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও তার শরিক দল বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছেন। বিগত ১০ বছর পেরিয়ে চলমান সরকার। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আজ প্রধানমন্ত্রী, তাঁর চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। কোটি কোটি তারার মধ্যে এক চাঁদ। এ চাঁদের আলোতে উদ্ভাসিত বাংলাদেশে। এ আলো চির প্রজ্জ্বলিত থাক এজন্য দেশপ্রেমিক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের জাগ্রত থাকা একান্তভাবে কাম্য।


কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ চোখের দৃষ্টিতে যা দেখছি তাতে রাজনীতির মধ্যে আজ কাকের সংখ্যা বেশি দেখছি। আধুনিক সমাজে শ্রমিক এবং মালিকদের মধ্যে সর্বদাই ভীষণ সংঘর্ষ হচ্ছে। এই সংঘর্ষ একটি আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করেছে এবং তার ফলে সমস্ত পৃথিবী বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। নামধারী শ্রমিক নেতাদের কারণেই অসহায় শ্রমিকরা চাকরি হারিয়ে রাজনীতির বলি হচ্ছে।

 

প্রকৃতি জগতে কাক পাখি আমাদের বন্ধু, পরিবেশ সুন্দর করায় তৎপর। ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করছে। ডাস্টবিনে বসে ময়লা আবর্জনা খাচ্ছে, কিন্তু কাকের শরীরে ময়লা থাকছে না। কিন্তু রাজনৈতিক আকাশের কাকগুলো ময়লা খাচ্ছে এবং সমাজে ময়লা ছড়াচ্ছে। আজ এ কথাগুলো বলতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ এক সময় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা সমাজের সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতো। সাধারণ মানুষ তাদের শ্রদ্ধা করতেন। আজ মানুষের শ্রদ্ধা ভক্তি কমে যাচ্ছে। কমে যাওয়ার কারণগুলো আর ব্যাখ্যা করতে চাই না।

 

তবে এ কথা সত্য মানুষের অর্থনৈতিক লোভ আকাশ স্পর্শ করছে। গ্রাম-গঞ্জে বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানবৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ধর্ষণ, ছিনতাই, ভূমি দখল, চাঁদাবাজি ও ঘুষ প্রবণতা অফিস-আদালতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। দুর্নীতি নির্মূলে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।

 

জাতির সেবার কাজে যে সেবকশ্রেণি রয়েছে তাদের অধিকাংশই খাদকের ভূমিকায় রূপ নিয়েছে। চিকিৎসা এবং ব্যাংক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। সেই চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভেজাল ঔষধ থেকে শুরু করে, চিকিৎসকদের এক্সরে বাণিজ্য। সরকারি হাসপাতালগুলোতে দরিদ্র মানুষ সেবা লাভের আশা করে। সেবা নিতে গিয়ে যে হয়রানীর শিকার হতে হচ্ছে তা ভুক্তভোগীরাই ভাল জানেন। একদিকে দালালদের দৌরাত্ম অপরদিকে এক্সরের ফিরিস্তি পকেট কাটার সু-কৌশলের জালে রোগীর ভোগান্তি। দুর্নীতির মানদণ্ডে একশ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তা নামে-বেনামে অর্থ লুট করছে। মনে হচ্ছে না ব্যাংকের টাকাও নিরাপদ। ব্যাংক কেলেংকারির সংবাদ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পরও তাদের বিচার হচ্ছে না। কালে-ভদ্রে তদন্ত কমিটির তদন্ত মাঝপথে হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে রয়েছে। 

 

বাংলাদেশের বিমান পরিবহন সংস্থা একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও লোকশান গুনতে হচ্ছে। স্বর্ণ পাচারকারীরা বাংলাদেশের আকাশ পথকে বেছে নিয়েছে। প্রায়ই বিমানের টয়লেট থেকে হাজার হাজার পিচ স্বর্ণ উদ্ধার হচ্ছে। এ স্বর্ণগুলো ঠিকমত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হচ্ছে কিনা এ নিয়েও আজ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কোথায়? শিক্ষার মান নিয়ে আজ জাতি হতাশায় নিমজ্জ্বিত। সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ পেয়েছে। রেজাল্টের দিক দিয়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা অনেক এগিয়ে রয়েছে। এ বিষয়টিকে কে কিভাবে নিবেন আমি জানি না। তবে ছেলেদের লেখাপড়া নিয়ে তাদের অভিভাবকরা দারুণভাবে চিন্তিত। এতে তেমন কেউ দ্বিমত পোষণ করছেন না। যারা পাশ করেছে তাদের কলেজে ভর্তি নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। শহরের ছাত্রদের যেমন তেমন গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীরা শহরে এসে ভর্তি হতে গেলে দালাল চক্রের হাতে পড়ছে। তবে পাশের হার বিচার্য যদি হয় তবে কিছুটা আশা থাকে, কিন্তু তারপরও অনেক ক্ষেত্রে মেধাবীরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। মেধাবীরা যাতে তাদের উন্নত জীবন গড়ার সুযোগ পায় সে বিষয়টি আমাদের সকলের কাম্য।

 

ভয় হয় আজ সবকিছুর মধ্যে রাজনীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তবে রাজনৈতিক গন্ধ যে পূর্বে ছিল না তা কিন্তু নয়। বর্তমানে আমরা অনেকেই সতীনাবাদে ব্যস্ত। কেউ কারো ভাল দেখতে পারছি না। আমাদের মন-মানসিকতার চরম অবনতি ঘটছে দিন দিন। কথায় আছে, সৃষ্টিকর্তা যা দিয়েছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট হও, অপরের ধন হরণ করো না। বর্তমানে আমরা তা মানছি না। ‘নিচেও কুড়াবো, গাছেও খাবো’ এই আর কী! রাতরাতি ধনাঢ্য হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্মীয় নীতি আদর্শ আমরা অনেকে মানতে পারছি না। সমস্যাটা এখানেই।

 

সরকারের ক্ষমাগুলোকে অনেকেই দুর্বলতা ভেবে নেতা-পাতি নেতার লেভাস পড়ে আকণ্ঠ দুর্নীতিতে মেতে উঠেছে। বিভিন্ন সরকারি-আধা সরকারি ও বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ। ডোল কাটা ইঁদুরের কাছে বিড়াল যাতে হেরে না যায় সেজন্য গেরস্থকে অবশ্যই অবশ্যই কঠোর দৃষ্টি দিতে হবে। সতীনের ছেলের ভাল কাজকে ভাল বলে মেনে নেয় না সৎ মা। বঙ্গবন্ধু এখানেই ব্যাতিক্রম ছিলেন তিনি বলেছিলেন, ‘সংসদে যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে সংখ্যায় কম হলেও আমরা তা মেনে নিবো।’


রাজনীতির সহনশীলতা এবং গণতন্ত্রের শিক্ষা সবাইকে ধারণ করতে হবে। মনে রাখা দরকার ভুলে গেলে চলবে না। আমরা ৩০ লাখ শহীদের প্রাণ ও লক্ষ মায়ের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই দেশ পেয়েছি। গুটি কয়েক অসাধু নেতা-নেত্রী, সরকারি-বেসরকারি অসাধু লোভী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য জাতির স্বার্থ সম্মান ভুলন্ঠিত হতে দিতে পারি না। আমাদের আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতির উন্নয়নের লক্ষ্যে স্ব স্ব স্থান থেকে দেশপ্রেমের আদর্শ বুকে ধারণ করে কাজ করতে হবে।

 

রণজিৎ মোদক
লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক এবং সভাপতি, ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব, নারায়ণগঞ্জ
মোবাইল : ০১৭১১৯৭৪৩৭২

এই বিভাগের আরো খবর