শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

রনজিত কুমার স্মরণে সাংস্কৃতিক সমাবেশ

প্রকাশিত: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪) : কবি, প্রাবান্ধিক, আবৃত্তিকার, সাংস্কৃতি সংগঠক এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম  আহ্বায়ক  রনজিত কুমার স্মরণে সাংস্কৃতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে । 

 

শুক্রবার (২২ ফেব্রুয়ারি ) বিকালে নগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রনজিত জংশন, নারায়ণগঞ্জ এ সাংস্কৃতিক সমাবেশের আয়োজন করে।


সভার শুরুতে রনজিত কুমারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১মিনিটের নীরবতা পালন করা হয় ।  রনজিত কুমারের কবিতা পাঠ করেন মনি সুপান্থ , নাসরিন আক্তার লুনা ও নুপুর সুলতানা এবং তাকে নিয়ে স্বরচিত কতিা পাঠ করেন নাফিজ আশরাফ, আরিফ বুলবুল, শ্যামল দাস, লোপা মমতাজ, শ.ম. মোজাম্মেল, আহম্মেদ বাবলু ,দীপক ভৌমিক এবং পল্লবী প্রত্যাশা । শাকিল আহম্মেদ সাজুর শুভেচ্ছা বক্তব্যের পর রনজিত কুমারের সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করেন দিনা তাজরিন । 

 

শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমির সভাপতি আবদুর রহমানের সভাপতিত্বে ও মিল্টন আনোয়ারের সঞ্চালনায় সাংস্কৃতিক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, সংস্কৃতিক সংগঠক রফিউর রাব্বি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম, লেখক ও গবেষক ফিরোজ আহম্মেদ, শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমির পরিচালক ধীমান সাহা জুয়েল, রনজিত কুমারের সহধমীণী সঞ্চিতা শর্মা এবং রনজিত জংশনের পক্ষ থেকে অমল আকাশ । 

 

সাংষ্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি বলেন, ৯২ সাল থেকে রণজিতকে আমার চেনা। রণজিতের সাংষ্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।  রণজিত সেই সংগঠক যার হাত ধরে একগুচ্ছ তরুণ এবং তরুণী তৈরী হয়েছে। যারা এখন বিভিন্ন সংগঠন আমাদের নারয়ণগঞ্জকে সমৃদ্ধ করে তুলছে।

 

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে সুবিধাবাদী যেই রাজনীতি, যা আমাদের শিক্ষাবিদ, শিল্পী ও গুণীজনদের গিলে খাচ্ছে তা থেকে বেড়িয়ে আসার যেই চেষ্টা , আমার বিশ্বাস যে এক দিন আমরা এই সুবিধাবাদী রাজনীতি থেকে বেড়িয়ে আসব।  গণতন্ত্রের কথা বলে আমাদের যেভাবে লুণ্ঠণ করা হচ্ছে তা থেকে আমরা বেড়িয়ে আসব। কারণ আমাদের একটা ঐতিহ্য রয়েছে। যা আমাদের বার বার এই অন্যায়, অত্যাচার ও অপরাধ থেকে বাঁচতে শেখায় এবং রনজিত এটাই শিখাতে চেয়েছিলেন।

 

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মকর্তা রফিকুর ইসলাম বলেন, রনজিত দাদা যে নারায়ণগঞ্জে কতটা ভালবাসার মানুষ ছিলেন, আজকে এই শহীদ মিনার ভর্তি মানুষের ভীড় তা কিন্তু বলে দিচ্ছে। আমাদের কাছেও তিনি অনেক প্রিয় মানুষ ছিলেন। তিনি প্রায় সময়তেই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পত্রিকা পড়তেন! আমরা তখন দুষ্টমির ছলে বলে উঠতাম দাদা  দেখবেন নিউজ পড়তে পড়তে আপনি আবার নিউজ হয়ে যাবেন না তো। তিনি যে এত দ্রুত চলে যাবেন তাও আমরা ভাবতে পারি নি।

 

লেখক ও গবেষক ফিরোজ আহম্মেদ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আমাদের দেশে কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে তা হয়তো আমাদের বর্তমান প্রজন্মের ছেরেমেয়েরা বুঝবে না। এই পতন কী গভীর একটা হতাশা বিচ্ছিন্নতা তৈরী করেছিল। মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভুলে গিয়েছিল।

 

তিনি আরও বলেন, সবাই ভাবত যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে এই পৃথিবীতে আর ভালো কিছু হবে না। সারা পৃথিবী ব্যাপী ইতিহসের সমাপ্তি ঘোষণা করেছিল অনেক দার্শনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। কিন্তু রনজিত কুমারের মতো মানুষ স্বপ্ন দেখা ছাড়ে নাই। তারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের সমাজেকে একটি সামগ্রিক বিনির্মাণের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নেয়া যায় তা শিখিয়েছেন। 

 

রনজিত কুমারের সহধমীণী সঞ্চিতা শর্মা বলেন, , আমার ছেলে মেয়েরা আমার কাছ থেকে শুনতে চায়। এখানে অনেক ছেলে মেয়ে আছে যারা আমাদের বাইশ বছরের বিবাহিত জীবনের প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত আমার এবং তাদের প্রিয় রনজিত দা’র সাথে ছিল। এই ছেলে মেয়গুলো  তার দাদাকে ভাল জানে।

 

স্মৃতি কাতর হয়ে তিনি আরও বলেন, আমার আজ মনে পড়ছে ৯৭সালের ১৪ই ডিসেম্বর ঢাকায় আমাদের বিয়ে হয়েছিল। ১৫ তারিখ সকালবেলা লোপা এবং মিল্টন আমাকে আমার বাসায় আনতে গেল। লোপা গিয়েই বলল! ভাবী তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে যান, আমাদের শ্রুতিতে কিন্তু দেরি হওয়ার কোন নিয়ম নেই। আমি একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে, শ্রুতিতে তো অনেক নিয়ম কানুন। আমি প্রথমেই তো দেরি করে ফেলেছি। আমি দাদাকে বললাম আমি তো দেরি করে ফেলছি! আমাকে বলল না, কিছু না রেডি হয়ে যাও।

 

বাড়ি থেকে নেমে সুন্দর একটি সজ্জিত গাড়ি দেখতে পেলাম। তখন আমি অবাক হয়ে গেলাম! কারণ আমি গ্রামে বড় হয়েছি আমি কখনো এমন সৌন্দর্য দেখি নি। আমি গাড়িতে করে নারায়ণগঞ্জ চলে আসলাম। তারা আমাকে বরণ করে নিল। তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।

 

তিনি আরও বলেন, আমি তাকে বলতাম তুমি ডাক্তারি পাশ করনি। তুমি বি.সি.এস দিলেও একটা ভাল চাকুরি করতে পারতে। তিনি বলতেন, আমি কিছুই করি নি তবে কিছু ভালো ছেলে তৈরী করেছি। ঐ দিন শহীদ মিনারে যেভাবে কাঁদল, পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্ক ছাড়া অন্য কেই এভাবে কাঁদে না। একজন তো মৃত্যু সংবাদ পেয়ে কানাডা থেকে চলে এসেছে ! আমি এখনো ভাবি যদি আমাদের আপন সন্তান এমন বিদেশে থাকত তাহলে এমনি করে চলে আসতো কি না ? 

 

সবশেষে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা করেন-ষড়জ সাংস্কৃতিক অঙ্গন, উদিচী শিল্পী গোষ্ঠী নারায়ণগঞ্জ জেলা সংসদ , শহুরে গায়েন, কফিল আহম্মেদ, লীলা ,সহজিয়া, সমগীত ও রনজিত জংশন ।

 

জানা যায়, নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরের মাতুলালয়ে ১৯৬২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রনজিত কুমারের জন্ম । পিতা রামেন্দ্র দাস নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনীতে কর্মরত ছিলেন, মা সবিতা রাণী দাস। নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমি থেকে এসএসসি, নটরডেম কলেজ ঢাকা থেকে এইচএসসি পাশ করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। রাজনীতি ও সাহিত্যের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে পড়েন ।  

 

তিনি ময়মনসিংহের সাহিত্য সংগঠন ‘বীক্ষণ’ এর আহ্বায়ক হন। পরে বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ময়মনসিংহের কাশিয়ার চরে ভুমিহীনদের খাসজমি উদ্ধারে আন্দোলনে যুক্ত হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে আহত হয়ে দীর্ঘদিন হাসপালে থাকেন । সুস্থ্য হয়ে  পূণরায় ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ভূমিহীনদের খাস জমি উদ্ধারের আন্দোলন করে গ্রেফতার  হন। আর এরই মধ্যে চুকে যায় তার চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাঠ । পরে মানবিক বিভাগ থেকে ¯œাতক সম্পন্ন করেন। দু’বছর কারাগারে থেকে ১৯৮৯ সালে মুক্তি পান । 

 

১৯৯০ সালে নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসেন এবং শুরু করেন শিশুদের সংগঠিত করার কাজ । ১৯৯২ সালে গড়ে তোলেন শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমি এবং পরে ধাবমান সাহিত্য আন্দোলন। এসব সংগঠনের মাধ্যমে নিয়মিত সাহিত্য, আবৃত্তি, সংগীত এবং অভিনয়ে কর্মী গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত হন ।

 

কর্মজীবনে রনজিত কুমার  ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুগরের আউট রিচ প্রকল্পের সমন্বয়ক । তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে তুলে আনেন মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ইতিহাস । সাহিত্যে তিনি কবিতা ও গদ্যে একাধারে বিচরণ করেছেন। লিখেছেন প্রবন্ধ, ছড়া ও শিশু নাটক । তাঁর প্রকাশিত কবতিা গ্রন্থ ‘এক সন্ধিক্ষণে দাড়িয়ে’ (২০১২), ‘প্রবন্ধ-নিবন্ধ নিয়ে চৌহদ্দির রিনিঝিনি’ (২০১৬), ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস : নারায়ণগঞ্জ জেলা ’ (২০১৭), সম্পাদনা গ্রন্থ’ ‘সমভূ মানব কথা ।’

 

১৯৯৭ সালে রনজিত কুমার বিশিষ্ট প্রকৃতি বিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মার ভ্রাতুষ্পুত্রী সঞ্চিতা শর্মাকে বিয়ে করেন । সঞ্চিতা শর্মা বর্তমানে মৌলভীবাজারের জেলার বড়লেখার সুজানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা । তাদের দুই সন্তান –প্রথম প্রান্ত (১৯) ও অনন্ত উৎসাহ (১৭)।

 

উল্লেখ্য, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২ জানুয়ারি সকালে তাঁর অস্ত্রোপচার । সেদিনই সন্ধ্যায় রনজিত কুমারের কর্মময় জীবনের পরিসম্পাপ্তি ঘটে। ৩ জানুয়ারি সকালে তার মরদেহ রাখা হয় নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে । সেখানে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন ও নেতৃবৃন্দের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নগরের মাসদাইর শ্মশানে তাঁর  শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।

এই বিভাগের আরো খবর