শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মেয়েকে খুঁজতে গিয়ে ছেলেধরা হলেন বাবা, ফিরলেন লাশ হয়ে

প্রকাশিত: ২১ জুলাই ২০১৯  

স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪) : জন্ম থেকেই বাকশক্তিহীন ছিলো সিরাজ। কানের শোনার শক্তিও ছিলো ক্ষীণ। তাই মৃত্যুর আগে বোঝাতে পারেনি সন্তানকে কাছে পাওয়ার আঁকুতি। বলে যেতে পারেনি সন্তানের প্রতি ভালোবাসার কথা। এ বাবার মনের গহীনে আত্মচিৎকারের শব্দ কানে যায় নি কারো।  


মেয়ের খোঁজে গিয়ে শনিবার ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হয় সিরাজ (৩০) নামে ওই যুবক। এ ঘটনায় রোববার নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় উপ-পরিদর্শক সাখাওয়াত হোসেন বাদি হয়ে ৭০ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত দেড় থেকে দুইশত জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। নিহত সিরাজ ভোলা জেলার লালমোহন থানার চরলেংগুটিয়া এলাকার আব্দুর রশিদের ছেলে। 


রোববার  বিকেলে মুঠোফোনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পরিদর্শক মো: সেলিম মিয়া এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
নিহতের পরিবার ও পুলিশ সূত্রে  জানা যায়, সিরাজ জন্ম থেকেই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। ১০ বছর আগে সিরাজের সাথে বিয়ে হয় শামসুন্নাহারের নামে এক নারীর বিয়ে হয়। বিয়ের পরে তাদের মিঞ্জু নামে এক কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। 


পরে ২০১৫ সালে সিরাজ  শামসুন্নাহারকে  নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলো এলাকার মোহন চান্দের বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস শুরু করে। এখানে এসে  প্রতিবেশী  মান্নানের সাথে শামসুন্নাহারের সাথে পরিচয় হয়। এক পর্যায় মান্নানের সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। 
পরে সাত মাস আগে শামসুন্নাহার সিরাজকে তালাক দিয়ে ৭ বছরের কন্যা মিঞ্জুকে নিয়ে মান্নানের সাথে পালিযে যায়।

 

এরপর থেকে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলো। মেয়ে ও স্ত্রীর খোঁজে প্রায়ই সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি আল আমিন নগর এলাকায় যেত।


সেখানেই পরিচয় হয় আইডিয়াল ইসলামিক স্কুলের  শিশু শ্রেণীর শিক্ষার্থী ও একই এলাকার সোহেল মিয়ার মেয়ে সাদিয়ার (৬) সাথে। মেয়ের মুখের সাথে মিল থাকায় সে সাদিয়াকে নিজের মেয়েভেবে প্রায়ই ওকে দেখতে স্কুলের সামনে আসতো।


শনিবার  সকালেও সে সাদিয়া দেখতে এসে হাত ধরে নিয়ে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু স্থানীয়রা ছেলেধরা সন্দেহে তাকে গণপিটুনী দিয়ে আহত করে। পরে পুলিশ খবর পেয়ে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।
নিহতের বাবা আব্দুর রশিদ জানান, আমার ছেলে কানে শুনতো না কথা বলতে পারতো না। আমার পা ভাইঙ্গা যাওয়ার পর থাইকা কাম করতে পারতাম না। শুধু অভাবের তাড়নায় ছেলেকে সিদ্ধিরগঞ্জে আনছিলাম।


তারপর বউডাও মাইয়া লইয়া চলে যায়। যাওয়ার পর থাইকাই মাইয়ারে খুঁজতো। খাইতো না ঘুমাইতো না খালি মাইয়া মাইয়া কইরা এদিক সেদিক খুঁজতো। ওদিন ও গেছিলো কিন্তু আমার পোলাডারে ওরা মাইরা লাইলো। আমি আমার পোলার খুনিগো বিচার চাই। 


অন্যদিকে ৪ বছর পূর্বে শারমিনের স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। এরপর থেকেই সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলো। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দেখলেই আদর করতে মরিয়া হয়ে উঠতে সে। 


এ কারণেই শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পাইনাদী নতুন মহল্লার শাপলা চত্ত্বর এলাকায় ইতালী প্রবাসী বিল্লালের বাড়ীর চার তলায় খাদিজার ফ্লাটে প্রবেশ করে তার নাতী নাদিমকে (৩) পুতুল দেয়। 


এতে পরিবারের লোকজনের সন্দেহ হলে বাড়িওয়ালাকে খবর দেয়। এ ঘটনায় ঐ বাড়ির সামনে জড়ো হয়ে পরে। এক পর্যায়ে উত্তেজিত জনতা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে গণপিটুনি দিয়ে পিএম এর মোড়ে আল বালাগ স্কুলে আটকে রাখে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে ঐ নারীকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য নারায়ণগঞ্জ ৩’শ শয্যা হাসপাতালে পাঠায়।


মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো: সেলিম মিয়া জানান, বাক প্রতিবন্ধী সিরাজকে পিটিয়ে হত্যা করায় উপ-পরিদর্শক সাখাওয়াত হোসেন বাদী হয়ে ৭০ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত দেড় থেকে দুইশত জনকে আসামি করা হয়েছে। 


একই দিন শারমিন নামে আরেক মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগে তার  মা তাসলিমা বেগম বাদী হয়ে ১৮ জনের নাম উল্লেখ ও এক থেকে দেড়শত জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুপুরে দু’টি মামলায় ১৪ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। 
 

এই বিভাগের আরো খবর