শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘বন্ধ্যা নারীর সন্তান প্রসব’

প্রকাশিত: ১৭ এপ্রিল ২০১৯  

দীর্ঘ ২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কার্যক্রম শেষ করেছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। একে দেশের মিনি পার্লামেন্ট বা দ্বিতীয় সংসদও বলা হয়ে থাকে। নব্বইয়ের পরবর্তী বিভিন্ন সময় তফসিল ঘোষিত হলেও ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ডাকসুর ইতিহাস হচ্ছে- প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ জাতির বিপদের সময় কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেছে।

 

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, সর্বশেষ একাত্তরে আমাদের চূড়ান্ত মহান স্বাধীনতা অর্জনে ডাকসুর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। জাতির দুর্যোগ মুহূর্তে ডাকসুর যুগান্তকারী ভূমিকার কথা সবাই জানি।

 

একটি দেশ সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব। গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ তেমন কোনো যোগ্য নেতা পেয়েছে কি ? এ প্রশ্ন কেউ করলে তা কি খুব অমূলক হবে ? অথচ ডাকসুর মাধ্যমে দেশ পেয়েছে অনেক যোগ্য নেতা। যোগ্য নেতা তৈরির আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত সেই ডাকসু নির্বাচন দীর্ঘ ২৮ বছর অনুষ্ঠিত হয়নি। এতে দেশ যোগ্য নেতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।


 
স্বয়ং রাজনীতি যাদের অপেক্ষায় থাকে, সেই তরুণরা আজ রাাজনীতিবিমুখ। আর দলীয় যে রাজনীতি চলছে; তা স্পষ্ট অতি রাজনীতিকরণ ছাড়া কিছু নয়। এতে নেতার সংখ্যা অনেক বেশি। তবে যোগ্য নেতা হাতেগোনা কয়েকজন। একদল শিক্ষক দলীয় রাজনীতিকেই মুখ্য দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছেন। ছাত্র-শিক্ষক মধুর সম্পর্ক দলীয় রাজনীতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাকসুই পারে এ কাঁটা উপড়ে ফেলে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে।


 
শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনেই নয়; একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও পিছিয়ে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এমন অভিযোগ হরহামেশাই শোনা যায়। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ অনুযায়ী, সিনেটের ১০৪ সদস্যের মধ্যে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি থাকার কথা।সেখানে ছাত্রদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরার কেউ নেই। তৃতীয় বর্ষে উঠেও হলে সিটের ব্যবস্থা হয় না অনেকের। হলের ক্যান্টিনগুলোর খাবার মান নিয়ে কথা বলতেও এখন শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধি নেই।


 
কথাসাহিত্যিক তুষার কণা খোন্দকার তার “ডাকসু নির্বাচন ২০১৯, নৈতিকতার নির্বাসন” নামে এক নিবন্ধে বলেন, দীর্ঘ ২৮ বছর পরে ২০১৯ সালে আবার ডাকসু নির্বাচন হলো। ডাকসু নির্বাচনে নতুন কিছু ঘটেনি। যা ঘটেছে সেটাকে নতুন বোতলে পুরাতন মদ বললে অত্যুক্তি হবে কেন?


 
ডাকসুর ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে গেছে বলে যারা অতি আবেগে চিৎকার করছেন তাদের আমি ১৯৭৪ সালের ডাকসু নির্বাচন স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। এ বছর ছাত্রলীগ যা আচরণ করেছে এটি তাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য। আমি এতে বিস্মিত হয়নি। আমি বিস্মিত হয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সীমাহীন অনৈতিকতা দেখে।


 
বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান “প্রাণহীন গুমোট হাওয়া বইছে” নামে এক নিবন্ধে বলেন, এখন দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দুর্নীতির অভিযোগের তীরে, অনিয়মের অভিযোগের তীরে, প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রশ্নে বিদ্ধ হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মর্যাদাবান সবার কাছে শ্রদ্ধার আসনে অভিষিক্ত উপাচার্যের বদলে শাসকদলের কর্মীর চেহারার শিক্ষকরা স্থান পাচ্ছেন।


 
একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় তার ইমেজ সংকটের মধ্যে পতিত হয়েছে। যুবলীগ করা, ছাত্রলীগ করা, জেলা আওয়ামী লীগের সংগঠনে থাকা শিক্ষকরা এমনকি সরাসরি সরকারি দল করা কর্মীর মতো আচার আচরণে অভ্যস্ত মেরুদন্ডহীন, ব্যক্তিত্বহীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দলবাজ শিক্ষকরা বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এখন।


 
সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারবিরোধী কোনো ছাত্র আন্দোলন নেই। তবু তারা সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের ক্যাডারদের লালন করেন। ছাত্রলীগের ইমেজ নষ্ট করেন তাদের ব্যাক্তিস্বার্থে। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মাসের পর মাস অনুপস্থিত থাকেন। ক্যাম্পাসে থাকেন না এমন অনিয়ম নির্লজ্জতা কখনো হয়নি। শিক্ষক-কর্মচারী থেকে সব নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ভিসি বিরোধী আন্দোলন হয়। জ্ঞানের তীর্থক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আর আলো ছড়ায় না। ক্ষমতার সুযোগ-সুবিধা ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসাব-নিকাশেই প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ব্যস্ত।


 
তাই এখন আর মেধাবী সন্তানরা অযত্ন অবহেলায় রুগ্ন হয়ে বের হয়। একদল শিক্ষকের জন্য সব শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় আজ ইমেজ সংকটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একসময় জাতির জনককেই নয়, জাতীয় নেতাদেরই নয়, আজকের প্রধানমন্ত্রীই নয়, অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর জন্ম দিয়েছে।


 
অসংখ্য মেধাবী দেশপ্রেমিক পেশাদার সরকারি কর্মকর্তা, শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক উপহার দিয়েছে। সমাজের সকল শ্রেণি-পেশায় আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মেধাবী সন্তানদের উপহার দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন দলবাজ শিক্ষক ও দলদাস, দলকানা, দলদাসী মানুষ উপহার দেয়।


 
প্রাচ্যের দ্বিতীয় অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা-দীক্ষার পাদপীঠ বলে কথা। দেশ তথা বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষা লাভ করার লক্ষ্যে আগত ছাত্র-ছাত্রী তারা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও জাতির সেবায় ব্রতী হয়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর শিক্ষার সুমহান বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির ধারা পাল্টে যেতে থাকে।
 


যাদের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন হলো। যুদ্ধ ক্ষেত্রেও বীরত্বের স্বাক্ষ্য রাখলো তাদের মধ্যে কতিপয় ছাত্রনেতা ক্ষমতার ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করেরাজনৈতিক দল গঠন করে। এক শ্রেণির ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল, টেন্ডার বাজী, ছাত্রভর্তি ব্যবসা শুরু করে। শিক্ষার উন্নয়নের দিকে না গিয়ে স্ব-স্ব ছাত্রনেতারা আর্থিক উন্নয়নে মেতে উঠে।


 
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বদলের পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতির রং পাল্টে যায়। শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্রের মহড়া চলে। গ্রাম-গঞ্জের দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণ করতে এসে অনেকে ক্যাডার বনে চলে যায়। আবার অনেকে নিরিহ ছাত্র রাজনীতির পাল্লায় যোগ না দেয়ায় লাশ গুমের শিকার হয়। এ কারণে সাধারণ মহলে ছাত্রদের প্রতি শ্রদ্ধার অংশ হ্রাস পেয়েছে। ছাত্রদের প্রতি জাতির আশা আকাঙ্খা নির্ভর করে। কিন্তু বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির ঢং দেখে অনেকেই ভ্যাংচি কাটেন।

 

এককালের ছাত্রনেতা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দেখার নামে ছাত্রদেরকে দিয়ে গণবাহিনী সৃষ্টি করে। গণমানুষের নেতাদের অত্যাচার-অবিচার ও গুপ্তহত্যা শুরু করে। দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে থাকে।


 
এ সুযোগে একশ্রেণির বিপদগামী সৈন্য জাতির পিতাকেসহ পরিবারে হত্যা করে। এরপর থেকেই মেধাবী ছাত্রদেরকে হাতে নিয়ে বহুদলীয় রাজনীতির নামে যুদ্ধপরাধীদের নিয়ে চলে দেশের রাজনীতি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানা গেছে, মেধাবী ছাত্রদের নৌবিহারে নিয়ে তাদের মগজ ধোলাইয়ের মন্ত্র দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজা-মন্ত্রী বানিয়ে দেওয়া হয়।

 

লিখিত-অলিখিতভাবে দীর্ঘ ২৮ বছর পর এ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এযেন বন্ধ্যা নারীর সন্তান প্রসব! আনন্দের বিষয় হলেও একশ্রেণির অসাধু নেতারা জলগোলা করার চেষ্টা করছে এবং দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব পড়েছে। তাই সাধারণ মানুষের একটাই চাওয়া- “যেমনটা বন্ধ্যা নারীর সন্তান প্রসব হয়েছে। ঠিক তেমনি সেই সন্তানকে হাঁটতে দিন-চলতে দিন, দয়া করে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দিন।”

 

রণজিৎ মোদক
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

এই বিভাগের আরো খবর