শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

পাওনা টাকা চাইলে যৌনকর্মী আখ্যায় ৩ নারীকে নির্যাতন, মামলা (ভিডিও)

প্রকাশিত: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

# ন্যায় বিচার চাই, নির্যাতনকারীদের শাস্তি দাবি করি : নির্যাতনের শিকার ফাতেমা
# মামলা পরিচালনায় ভুক্তভোগীর সর্বাত্মক সহযোগিতায় পাশে থাকবে মানবাধিকার কমিশন  : পরিচালক ফয়জুর
# কোন পারিশ্রমিক ব্যতিরেকে নির্যাতিতদের সবধরণের আইনীসেবা প্রদান করবো : এড.দিপু
#  আসামীদের গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে: বন্দর থানা ওসি রফিকুল

স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪) : বন্দরের দক্ষিণ কলাবাগান এলাকায় দুই মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে বসবাস করতেন খালপারের মৃত মফিজ উদ্দিনের মেয়ে ফাতেমা বেগম ওরফে ফতেহ (৫০)। এক মেয়ে রোকসানাকে বিয়ে দিয়েছেন পাশের গ্রামেই। ফাতেমার কাছ থেকে প্রতিবেশী উম্মেহানীর স্বামী বিদেশ পাঠানোর কথা বলে ১ লাখ ২২ হাজার টাকা ধার নেন। এই ধারের টাকাই উদ্ধার করতে গিয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি নির্যাতনের শিকার হন ফাতেমা এবং তাঁর দুঃসম্পর্কের খালাতো বোন আসমা বেগম (৩৫)।  নির্যাতনের শিকার অপর নারী বুরুন্দি এলাকার বকুল মিয়ার স্ত্রী বানু বেগমকে (৩০) চেনেননা ফাতেমা বেগম।

যৌনকর্মী আখ্যা দিয়ে তিন নারীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় তিন নারীর উপর নির্যতন চালানো হয়। ওই তিন নারীকে ঘর থেকে বের করে টেনে হিচড়ে গাছের সাথে বেঁধে লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারধর করে ইউসুফ মেম্বারের নেতৃত্বে এলাকার কথিত বিচারকরা। কেবল মারধরই নয় জোর করে ওই নারীদের মাথার চুলও কেটে দেয়া হয়। এরপর ওই অবস্থায় কয়েক ঘন্টা গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয় তাদের। খবর পেয়ে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করলেও নির্যতানকারীদের বিরুদ্ধে কোন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশিত হলে সোমবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে মানবাধিকার কমিশনের একটি দল নির্যাতনের শিকার তিননারীকে সার্বিক সহযোগিতার প্রয়াস নিয়ে নারায়ণগঞ্জে আসেন। নির্যাতনের শিকার ফাতেমা বেগমের সাথে কথা বলে তারা  ঘটনার বিস্তারিত শোনেন। পরে বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলামকে মামলা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেন।

এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের সকল প্রকার দায়িত্ব নেবে বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার কমিশন। আর মামলা পরিচালনার সকল কিছুর দায়িত্ব নেন আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু। 

সোমবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) জেলা ও দায়রা জজ আল মাহমুদ ফায়জুল কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম জেলা আদালতে আসেন। টিমের অন্য দুই সদস্য হলেন, উপ পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) গাজী সালাম ও সদস্য বাঞ্চিতা চাকমা।

নির্যাতনের স্বীকার ফাতেমা আক্তার ওরফে ফতেহকে হাসপাতাল থেকে তাঁর বোন হালিমা ও বোনের মেয়ে সনির মাধ্যমে আদালতে নিয়ে আসা হয়। পরে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সম্মেলন কক্ষে মানবাধিকার কমিশনের সদস্যদের কাছে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন ফাতেমা। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্নগুলোও দেখান তিনি। এসময় বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলামও সেই সভায় যোগ দেন।

ফাতেমা বেগম মানবাধিকার কমিশনের সদস্যদের জানান, মূলত দুই মাস আগে দেয়া পাওনা টাকা ঘটনার দিন সকাল ৮টায় আনতে গেলে প্রতিবেশী উম্মেহানি তা অস্বীকার করে। পূর্বশত্রুতার জের ধরে ভাগ্নি জামাই ইউসুফ মেম্বার উম্মেহানির সাথে হাত মেলায়। ওইদিন উম্মেহানি পাওনা কোন টাকা পাবেননা বলে ফাতেমাকে জানায়। এবং এর স্বাক্ষী হিসেবে ইউসুফ মেম্বারের কথা বলেন। তাঁর নেতৃত্বে এরআগেও ফাতেমার বাড়িতে হামলা করা হয় বলে জানান তিনি।

ফাতেমা এরপরও পাওনা টাকা দিতে বলে চলে গেলে দুপুরের দিকে ইউসুফ মেম্বার, মতিন, মাসুদা, জীবন, তরিবা, এলিজা, সুমন, আলমগীর, আমান, নাসির, রুবেল, মুরাদ, নাসরিন তার বাড়িতে এসে আক্রমন করে মারধর শুরু করে। এলিজা, সুমন  ও মাসুদা এ তিনজন চুল কাটার নেতৃত্ব দেন। আর মতিন আমাকে ধরে রাখে। এরপর কি হয়েছে তিনি আর বলতে পারেননা। তার তাঁর দুঃসম্পর্কের খালাতো বোন আসমা বেগমকেও তারা একইভাবে নির্যাতন করেন। তবে নির্যাতনের শিকার আরেক নারীকে তিনি চেনেননা বলে জানান। ওই নারী স্মার্ট কার্ড নিতে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে আক্রমনকারীরাই এ বাড়িতে ধরে নিয়ে এসেছে বলে জানান তিনি।

ফাতেমা বেগম বলেন, আমার বাড়িঘরে লুটপাট করা হয়েছে। আমার পরিবারের উপর নির্যাতন করা হয়েছে। আমাদের হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। আমি এসবের ন্যায্য বিচার দাবি করছি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগ ও তদন্ত বিভাগের পরিচালক  আল মাহমুদ ফায়জুল কবির সাংবাদিকদের জানান, ভুক্তভোগীর সাথে আলাপ হয়েছে। তার কাছ থেকে বিস্তারিত জেনেছি। পরে বন্দরের ওসি সাহেবের সাথে আলাপ হয়েছে। যে ঘটনা ঘটেছে তা জামিন অযোগ্য অপরাধ। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী বাদী হয়ে থানায় মামলা করবেন। থানায় মামলা নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এই মামলা পরিচালনায় ভুক্তভোগীর সর্বাত্মক সহযোগিতায় পাশে থাকবে মানবাধিকার কমিশন। এছাড়া জেলা প্রশাসক ও  পুলিশ সুপারের সাথে এ বিষয়ে আলাপ করবেন বলেও জানান তিনি।

আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু বলেন, আমি সকালে নির্যাতনের স্বীকার ফাতেমার বোন ও তার মেয়েকে আদালতে ঘোরাঘুরি করতে দেখি। এসময় তাদের কাছ থেকে ঘটনাটি জানতে পেরে মামলা করার ব্যাপারে উৎসাহ দেখাই। তবে তারা মামলাটি দূর্বল হতে পারে ভেবে প্রথমে আগ্রহ দেখায়নি। দুপুরে মানবাধিকার কমিশনের একটি টিম নারায়ণগঞ্জে আসছে জানতে পারি। সেই টিমের দুজন আমার পূর্বপরিচিত। ঘটনার বিস্তারিত শুনে মানবাধিকার কমিশনের সকলে আমাকে মামলা তৈরি করতে বলেছি। আমি এমনভাবেই মামলা করবো যাতে কোন আসামী জামিনে বের হতে না পারেন। এবং এই মামলায় কোন পারিশ্রমিক ব্যতিরেকে আমি তাদের আইনী সহায়তা প্রদান করবো। প্রশাসন মামলা নেয়ার পর থেকে আইনি যেকোন সহযোগিতার জন্য আমি তাদের পাশে আছি।

এদিকে সন্ধ্যায় তিননারীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বর নির্যাতনের ঘটনায় বন্দর থানায় মামলা দায়ের করেন নির্যাতনের শিকার ফাতেমা বেগম ফতেহ। মামলার এজহারে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ১৫/২০ জনকে আসামি করা হয়। 

মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করে বন্দর থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, মামলায় উল্লেখ করা বর্ণনার সাথে বাস্তবতার মিল পেয়েছি। আসামীদের গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

এদিকে সরেজমিন ঘুরে যুগের চিন্তা ২৪’র বন্দর প্রতিনিধি জানান, ফাতেমা বেগমের ঘরের প্রতিটি আসবাব ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। দেখলে মনে হবে নির্যাতিত ফাতেমার বাড়ির উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। পুরো বাড়ি ধ্বংস স্তুপে পরিণত। ঘরের মধ্যে আগুনে পোড়া আসবাবপত্রও লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া ঘরের মধ্যে মূল্যবান কোনো আসবাবপত্র নেই। বাড়ির পাশের খালের পাশে গিয়ে দেখা যায় বাড়ির অধিকাংশ সাংসারিক জিনিসপত্র খালে পড়ে আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলকাবাসীদের কয়েকজন জানান, ঘরে থাকা সকল জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে  গেছে।  নির্যাতনের সময়ে পুরো বাড়ি তছনছ করে ফেলা হয়েছে। 

 


 

এই বিভাগের আরো খবর