শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ত্বকী হত্যার ছয় বছর এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি

প্রকাশিত: ৫ মার্চ ২০১৯  

৬ বছর হয়ে গেল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া প্রতিশ্রুতি আজও বাস্তবায়ন হলো না। এমন ঘটনা অবশ্য বহু ক্ষেত্রেই ঘটতে দেখছি কিন্তু দু’একটি ক্ষেত্রে তিনি বেশ ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। ত্বকী হত্যার পর নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়ন সেলিনা হায়াৎ আইভীকে বলতে শুনলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি তাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ত্বকী হত্যার বিচার তিনি করবেন, এক মাস না হলে দুই মাস পরে, তা না হলে ছয় মাস পরে তিনি এ বিচার করবেন।


পরে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পূর্বে সেলিনা হায়াত আইভী ও ‘অতিপ্রিয়’ আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের সাথে গণভবনে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ত্বকী হত্যা প্রসঙ্গে বলেছেন, এ হত্যার সাথে কারা কারা জড়িত তা তিনি জানেন এবং এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সকল গোয়েন্দা রিপোর্ট তার কাছে আছে। তিনি এর বিচার করবেন। সংবাদ মাধ্যমে আমরা এসব জেনেছি।


দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ও ক্ষমতাশীন জোট নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ‘এ হত্যার বিচার এক, দুই বা ছমাসে হবেই’, সে ছয় মাস কতোবার যে পেরিয়ে গেল এবং হায়রে, ৬ বছরও পার হয়ে গেল কিন্তু আজও পর্যন্ত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর নিষ্ঠুরতম হত্যা বিচারের মুখ দেখলো না। 


কে এই তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী ? ত্বকী হলো নারায়ণগঞ্জের সচেতন নাগরিকদের কাছে সবিশেষ পরিচিত সংগঠক, লেখক-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিজন রাফিউর রাব্বির প্রথম সন্তান। কি সুদর্শন এই কিশোর ত্বকী। কেবল স্নিগ্ধ চেহারার অধিকারীই নয়, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার এক অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্তও বটে। তার লেখা ওই বয়সেই যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষার ওপর তার দক্ষতা, লেখা এবং কাব্যচর্চা যেকোন মানুষকে আকৃষ্ট করবে। এই প্রিয়দর্শন ত্বকী চিন্তা ভাবনায় ছিল এমনই অগ্রসর যে, প্রগতিশীল দর্শন ও সাহিত্যের প্রতি সে ছিল আকৃষ্ট।


আমাদের কষ্টটা আরও বেড়েছে তার কারণ, কিশোর ত্বকী বাবার হাত ধরে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে নিজেকে অন্তর্ভূক্ত করেছিল। আমরা যে প্রতুৎপন্নমতি প্রতিভাকে হারালাম, তার দু:খ আমাদের আজও পীড়া দেয় এবং নিরন্তর দিতে থাকবে।


ত্বকীর বাবা রাফিউর রাব্বি জনগণের কল্যাণার্থে নারায়ণগঞ্জে বাস ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ‘যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম’ গঠন করেছিলেন। সকল পেশা ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষকে একত্র করে এবং তিনি ছিলেন এর আহ্বায়ক। ২০১১ সালের সে আন্দোলনের ফলে মালিক পক্ষ ভাড়া কমাতে বাধ্য হয়েছিল। গণ-পরিবহনের ভাড়া একবার বাড়লে তা আবার কমার নজির আমাদের নেই। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে সে নজির তৈরী হয়েছিল।


আবার সে বছরই নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের নেতা শামীম ওসমানের প্রতিদ্বন্দ্বি হলেন আওয়ামী লীগেরই সদস্যা তবে প্রার্থী হলেন নাগরিক পরিষদের। আবার এই কমিটিতেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এমনকি আওয়ামী লীগের একাংশ যুক্তও হলেন। সে নাগরিক পরিষদের সদস্য সচিব হলেন রফিউর রাব্বি।


আইভী সে নির্বাচনে শামীম ওসমানকে হারিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র পদে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করলেন। (এরপর পরাজিত প্রার্থীর কতো নাটকই না আমরা প্রত্যক্ষ করেছি)। বাসভাড়া কমানোর আন্দোলন ও সিটি নির্বাচনে আইভীর পক্ষে অবস্থান নেয়ায় রাফিউর রাব্বির ওপর যে আক্রোশ তা মেটাবার জন্যেই তার পুত্র ত্বকীকে হত্যা করা হলো। 


ত্বকী হত্যার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব ২০১৪ সালের ৫মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল শামীম ওসমানের ভ্রাতুষ্পুত্র (নাসিম ওসমানের ছেলে) আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। হত্যার কারণ হিসেবে তখন তারা উল্লেখ করেন ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বির বাসভাড়া আন্দেলন ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তার ভূমিকা। রফিউর রাব্বিকে শায়েস্তা করতেই তার অজাতশত্রু পুত্রকে ১১জন পাষণ্ড নরঘাতক মিলে আজমেরী ওসমানের টর্চার সেলে তারই উপস্থিতিতে হত্যা করেছে। 


ঘাতকরা ২০১৩ সালের ৬ই মার্চ ত্বকীকে পথের মাঝখান থেকে তুলে নিয়ে যায়। প্রথমে তারা ত্বকীকে গজারির লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করে, পরে বুকের উপর উঠে গলা টিপে শ্বাস রোধ করে হত্যা করে। ঘাতকরা তার একটি চোখ উপড়ে আনে, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ থেতলে দেয়। ঐ দিনই রাত বারোটার আগেই ত্বকীকে হত্যা করে তারা তার লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়। দুই দিন পর ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর পারে ত্বকীর ক্ষত-বিক্ষত নিথর শবদেহটি পাওয়া যায়। 


যে এগারো জন ঘাতক ত্বকীকে হত্যা করেছিল তাদের মধ্যে ৫-৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মামলাটির তদন্তকাজ প্রথমে পুলিশ শুরু করলেও তিনমাস পরেই তাদের তদন্ত থমকে যায়। পরে রফিউর রাব্বির আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয় র‌্যাবের মাধ্যমে তদন্ত সম্পন্ন করার জন্য। র‌্যাব তদন্ত-ভার নিয়ে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ২ জন সুলতান শওকত ভ্রমর ও ইউসুফ হোসেন লিটনের ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী গ্রহণ করে।


ভ্রমর তার জবানবন্দীতে উল্লেখ করে, আজমেরী ওসমানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ও উপস্থিতিতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। পরে র‌্যাব আজমেরী ওসমানের টর্চার সেলে অভিযান চালিয়ে হত্যার বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে। ৫মার্চ ২০১৪ সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব হত্যার সকল বিবরণ উপস্থাপন করে। র‌্যাব তখন উপস্থিত সাংবাদিকদের একটি খসড়া অভিযোগপত্রও সরবরাহ করেছিল।


আমরা ত্বকী হত্যার প্রথম বর্ষপূর্তিতে ২০১৪ সালের ৬মার্চ  দেশের প্রায় সকল সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় দেখলাম ‘আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে’ শিরোনামে সংবাদ। সংবাদে ত্বকীর ছবি কোন কোন সংবাদ পত্রে আজমেরীরও ছবি ছাপা হলো। কিন্তু তার পরেও পাঁচ বছর চলে গেল, হায় সে অভিযোগপত্র আজও আলোর মুখ দেখলো না।


২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল কুখ্যাত ৭ খুন মামলা জনসমক্ষে এলো। শামীম ওসমানের ভাই নাসিম ওসমান চিকিৎসার জন্যে ভারতে গেল। কিন্তু সেখানেই ৩০ এপ্রিল তার মৃত্যু হলো। নাসিম ওসমান ছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য আর সে কারণেই তার মৃত্যুর পর পরিষদে আনীত শোকপ্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্লামেন্টের ফ্লোরে দাঁড়িয়েই বলেন, ‘আমি ওসমান পরিবারকে দেখে রাখবো।’


ফলে সচেতন পাঠক, আপনাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করছি দেশের প্রধানমন্ত্রী যে পরিবারকে দেখে রাখবেন বলে অঙ্গীকার করেন, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করে অভিযোগপত্র পেশ করলেও কী তার ফলাফল পাওয়া যায় ? তাহলে কি আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে পারি (অপরাধ হলে ক্ষমা করবেন) এমনই যদি অবস্থান হয় প্রধানমন্ত্রীর তবে তিনি যে ৬ মাস পরে হলেও বিচার হবে বলেছিলেন, তার কী হবে ? ৬ মাসতো দূরের কথা ৬ বছর পেরিয়ে গেল প্রধানমন্ত্রী আপনি আজও এর সুরাহা করেননি।


উল্টো যে প্রশ্নবিদ্ধ রাজনীতিবিদ এই অভিযোগের সাথে সম্পৃক্ত বলে সকলের সন্দেহ, তাকেই আবার দলীয় মনোনয়ন দিয়ে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮’র নির্বাচনে অটো প্রমোশন দিয়েছেন। আবার এই শামীম ওসমান আপনার সামনে মেয়র সেলিনা হায়াত আইভি’র সাথে ‘ভাই-বোন’ সম্পর্কের ম্যাজিক দেখিয়ে পরে তিনি কি করেছিলেন তা নিশ্চয়ই সংবাদ পত্রের মাধ্যমে জেনেছেন। এমনকি ৭১ টেলিভিশনের টক শো অনুষ্ঠানে শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াত আইভী’র বাক বিতণ্ডার পর আইভীকে যে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন তাও নিশ্চয়ই ৭১ টেলিভিশনের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শুনেছেন।


মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনিতো জানেন হেফাজতে ইসলাম যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ করে শহরের সচিবালয় দখলের পায়তারা করেছিল এবং কী কুৎসিত সংঘাত ও অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে পবিত্র কোরআন শরিফসহ ধর্মীয় পুস্তকাদিতে অগ্নিসংযোগ করে শহরে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছিল। আর তাদের তখন আপনার সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বিরিয়ানী ও তরমুজ দিয়ে আপ্যায়ণ করেছিলেন। এতসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেও ঢাকার গুলশানে বসবাসকারী শামীম ওসমানকে নারায়ণগঞ্জ শহরের এমপি করে পার্লামেন্টে নিয়ে এসেছেন। 


যে শামীম ওসমান ত্বকী হত্যার বিচার চাওয়ার অপরাধে (!) রাফিউর রাব্বির বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছে, হেফাজতকে দিয়ে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ধর্ম-অবমাননার মামলা দিয়েছে, মেয়র আইভী এমনকি রাব্বির সহযোগীদের নানাভাবে হয়রানি ও হেনস্থা, হুমকি, ধমকি দিয়ে চলেছে গত ৬ বছর ধরে। রফিউর রাব্বি ও তার সহযোগীদের পিঁপড়ের মতো পিষে মারার ঘোষণা দিয়েছে, টুকরো টুকরো করে কেটে শীতলক্ষ্যায় ফেলে তা মাছদিয়ে খাওয়ানোর মতো ঘোষণা দিয়েছে।


এ সবই সংবাদ পত্রে দেশবাসী জেনেছে। যে ঘাতকের টর্চার সেলে এমনি নির্মমভাবে ত্বকীকে হত্যা করা হলো, ১৬৪ ধারার জবানবন্দীতে যার নাম এলা, যার টর্চার সেলে হত্যার আলামতও পাওয়া গেল সে ঘাতক আজমেরী ওসমানকে আজও পর্যন্ত গ্রেফতার করা হলো না। বরং সে বীরদর্পে প্রশাসনের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। 


মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার এ ব্যাপারে আন্তরিকতা আছে, সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু বাস্তব হলো ত্বকীর মতো এক প্রতিভাবান কিশোরের কোনো অপরাধ না থাকা সত্ত্বেও তাকে যারা হত্যা করলো তাদের অথবা তাদের অভিভাবকদের আজ পর্যন্ত কারও কোনো বিচার হলো না। আমরা যারা ক্ষুব্ধ, কী করে আশ্বস্ত হই এবং ভাবি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বলেছেন, তখন তিনি বিচার করবেনই।


কিন্তু প্রশ্ন একটাই, কবে ? ক্ষমা করবেন, আদৌ কি বিচার হবে ? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আপনার দেয়া প্রতিশ্রুতি কার্যকর না হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও কর্ম-কর্তাদের বেশ ‘ধমকের সুরে’ই নির্দেশ দেন সেই কাজটি করার জন্যে। যেমন দেখলাম সেদিন সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে বিচারের রায় বাংলায় লেখার জন্যে অনুরোধ করেছেন। ত্বকী হত্যার ক্ষেত্রে আপনিতো আপনার ক্ষমতার জোরে র‌্যাবকে নির্দেশ দিতে পারেন অভিযোগপত্র আদালতে পেশ করার জন্যে, তাই নয় কী ? 


কামাল লোহানী
লেখক : ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক
 

এই বিভাগের আরো খবর