শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

গুদামেই নষ্ট হচ্ছে পেঁয়াজ, ফেলা হচ্ছে নদী-ডাস্টবিনে

প্রকাশিত: ১৭ নভেম্বর ২০১৯  

ডেস্ক রিপোর্ট (যুগের চিন্তা ২৪) : চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে পেঁয়াজের খুচরা বাজারে। তদারকি না থাকায় দিনের আলো ফুটতেই যে যেভাবে পারছে দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট কাটছে।দামের অপ্রতিরোধ্য যাত্রায় খুচরা বাজারে গতকাল শনিবারও বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। দামের অপ্রতিরোধ্য যাত্রায় খুচরা বাজারে গতকাল পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৬০-২৭০ টাকায়। 

 

এ অবস্থায় সুসংবাদ দিল রাজধানীর কারওয়ানবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা। তারা বলছেন, শুক্রবারের তুলনায় গতকাল শনিবার পাবনাসহ কয়েকটি জায়গা পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম প্রতিকেজিতে ১০ টাকা করে কমেছে। আজ রোববার ঢাকাতেও ১০ টাকা করে কমবে। কারওয়ানবাজারের কয়েকজন পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। 

 

এ বিষয়ে পাবনা থেকে কারওয়ানবাজারে পেঁয়াজ সরবরাহকারী পাইকারি ব্যবসায়ী নিতাই বাবু বলেন, ‘শনিবার পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম ২২০-২৩০ টাকা চলছে। তবে রোববার ঢাকা পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা কমতে পারে। কারণ গতকাল পাবনায় প্রতিমণে ৩০০-৪০০ কমে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। পাবনার পেঁয়াজ শনিবার রাতের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাবে, ভোরে এসব পেঁয়াজ বিক্রি করা হবে। 

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারওয়ানবাজারের আড়তদার মমতাজ এন্টারপ্রাইজের মালিক কাজী মো. মোস্তফা বলেন, ‘পেঁয়াজ কম দামে আমদানি করে সিন্ডিকেট করে মানুষের বিরুদ্ধে হতাশা সৃষ্টি করে। যারা আমাদানি করছে তারা ১০ জন আমদানি করলে দুজন বাজারে ছাড়ে। আর বাকি আটজনেই বেশি লাভের আশায় পেঁয়াজ গোডাউনে মজুত করে রাখে।’ 

 

সরকারকে এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানান এ ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, একজন আমদানিকারক পেঁয়াজ আমদানি করে কেজিতে ৫ বা ১০ টাকা লাভ করতে পারে, এ জন্য সরকার নীতিমালা করে দিলে ভালো হয়। তিনি আরও বলেন, তবে আশার কথা হচ্ছে আজকে পাবনাসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় পেঁয়াজের দাম কমেছে। আগামীকালও ঢাকায় পেঁয়াজের দাম কমবে। 

 

খুচরা বিক্রেতারা আমাদের কাছ থেকে কম দামে কিনলেও দু-এক দিন আগের বেশি রেটেই বিক্রি করে উল্লেখ মোস্তফা বলেন, আমাদের কাছ থেকে খুচরা বিক্রেতারা ২২০ টাকা করে পেঁয়াজ কিনলেও তারা বিক্রি করে ২৬০ টাকা, তাদের আসলে বিক্রি করা উচিত ছিল ২৩০ টাকা। খুচরা বিক্রেতাদের সর্বোচ্চ ১০ টাকা লাভ করা উচিত। কিন্তু তারা অতিরিক্ত লাভ করে। 

 

এ আড়তদার বলেন, আমি পাবনা, ফরিদপুর আর রাজবাড়ীর পেঁয়াজ আনি। এসব দেশি পেঁয়াজের দাম একটু বেশি থাকে। আমদানি করা পেঁয়াজের দাম কিছুটা কম। আমদানি করা পেঁয়াজ কম দামে আনলেও বাজারে ছাড়ে দেরি করে। দেশি পেঁয়াজ আর কত দিনের মধ্যে উঠবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে পাতা পেঁয়াজ উঠা শুরু করেছে। আর এ মাসের শেষের দিকেই পেঁয়াজ উঠা শুরু করবে। তখন প্রতিদিন কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা কমতে শুরু করবে।

 

কারওয়ানবাজারের আরেক আড়তদার মেসার্স মাতৃভান্ডারের মালিক কালাম শেখ বলেন, কৃষক পেঁয়াজ ধরে রাখে, দাম উঠলে বিক্রি করে। দেশের বাইর থেকে বেশি বেশি আমদানি করা সম্ভব হলে পেঁয়াজের বাজার এমনিতেই কমে আসবে। তিনি বলেন, ‘যদি আগেই বাণিজ্যমন্ত্রী বিভিন্ন আমদানিকারকের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতো যে, চাহিদা অনুযায়ী পেঁয়াজ আমদানি কর এবং সে অনুযায়ী যদি আমদানি হতো তাহলে বাজারে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। কালাম বলেন, গতকালকের মতই আজও দেশি হাইব্রিড পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ২৩০ টাকা, দেশি ভালোটা বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকা, মিসরেরটা ১৯৫ টাকা এবং মিয়ানমারেরটা বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়। 

 

এদিকে বাজারে সরবরাহে মারাত্মক সংকটের মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীতে ভোগপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের আড়ত থেকে ডাস্টবিন, খালের পাড়ে-নদীতে ফেলা হচ্ছে বস্তায়-বস্তায় পচা পেঁয়াজ। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা জানিয়েছেন, গত তিনদিন ধরে খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন মার্কেটের গুদাম থেকে ফেলা ১৫ থেকে ১৬ মেট্রিক টন পঁচা পেঁয়াজ তারা অপসারণ করেছেন। 

 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রতিনিধিরা এবং খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোর জন্য আড়তদারেরা এসব পেঁয়াজ মজুদ করে রেখেছিলেন। মজুদ করা পেঁয়াজ পঁচে যাওয়ায় সেগুলো এখন আবর্জনার স্তুপে ফেলা হচ্ছে। তবে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের গুদামে কোনো পেঁয়াজ মজুদ নেই। মিয়ানমার থেকে যেসব পেঁয়াজের চালান আসছে, সেখানেও পচা পেঁয়াজ আছে। সেগুলো ফেলে দেওয়া হচ্ছে। 

 

গতকাল শনিবার নগরীর খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন মার্কেটে পেঁয়াজের গুদাম ও পাইকারি বিক্রয় প্রতিষ্ঠানে বস্তায়-বস্তায় পচা পেঁয়াজ দেখা গেছে। আবার পচা পেঁয়াজের বস্তা বিক্রি হতেও দেখা গেছে। সকালে হামিদউল্লাহ মার্কেটে নুরুল ইসলাম ও দ্বীন ইসলাম নামে দুই ভাই ১০০ টাকা দরে প্রতিবস্তা পেঁয়াজ কিনছিলেন। উচ্চমূল্যের মধ্যে পঁচা-নষ্ট পেঁয়াজ থেকে কিছুটা ভালোগুলো বেছে নিয়ে বিক্রির জন্য তারা কিনছেন বলে জানান। 

 

এর আগে বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল শনিবার সকাল পর্যন্ত খাতুনগঞ্জ সংলগ্ন চাক্তাই খালপাড় ও কর্ণফুলী নদীতে এবং পাড়ে ফেলা হয় কয়েকশ’ পেঁয়াজের বস্তা। রাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা সেই পেঁয়াজ নিয়ে বায়েজিদ বোস্তামি থানার আরেফিননগরে আবর্জনাগারে ফেলছেন। এছাড়া নদী ও এর পাড় থেকে অনেকে পঁচা পেঁয়াজ কুড়িয়ে রোদে শুকাতে দেখা গেছে। 

 

নগরীর ৩৫ নম্বর বক্সিরহাট ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক আহমদ ছফা বলেন, খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মার্কেটে, সামনের রাস্তায়, চাঁন মিয়া বাজার ও মধ্যম চাক্তাই এলাকায় পচা পেঁয়াজ পেয়েছি। চারটি ট্রাকে করে আমরা সেগুলো আরেফিননগরে ময়লার ভাগাড়ে ফেলেছি। 

 

হামিদুল্লাহ মার্কেট কাঁচামাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, মিয়ানমার থেকে নৌকায় করে পেঁয়াজ আসছে। যেসব পেঁয়াজ নৌকার তলায় থাকে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। গুদামে আসার পর সেগুলো ফেলে দিতে হচ্ছে। যেসব পচা পেঁয়াজ ফেলে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো মিয়ানমারের পেঁয়াজ। 

 

ক্যাবের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ তদারকির অভাবে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা মজুতদারির সুযোগ নিয়েছে। মজুদের মাধ্যমে বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি করে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। মজুদ করা যেসব পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারেনি, পঁচে গেছে, সেগুলো এখন ভাগাড়ে ফেলা হচ্ছে।’ 

 

ব্যবসায়ীরা জানান, মায়ানমার থেকে শুক্রবার ১৬৮ টন পেঁয়াজ খাতুনগঞ্জে এসেছে। গতকাল শনিবার দুপুর পর্যন্ত এসেছে ৭০টন। শনিবার খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে প্রতিকেজি মায়ানমারের ভালো পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল ২২০ টাকায়। কিছুটা নিম্নমানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। 

 

গত সেপ্টেম্বরে ভারত আকস্মিকভাবে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। মুহূর্তের মধ্যে বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করে। পাইকারিতে কেজিপ্রতি ৩০ টাকার পেঁয়াজ দিনশেষে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে বিক্রি হতে শুরু করে। আর খুচরা বাজারে সেটা ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। 

 

এই অবস্থায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজার, আমদানিকারকের আড়তে অভিযান শুরু করে।পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও করে প্রশাসন।প্রতিবার অভিযানের পর পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৫-১০ টাকা কমলেও এক-দুইদিন পরই তা আবারও বেড়ে যায়।এ অবস্থায় হাল ছেড়ে দিয়েছে প্রশাসনও। 


অপরদিকে মিসর থেকে কার্গো বিমানযোগে আমদানিকৃত পেঁয়াজের প্রথম চালান ঢাকায় পৌঁছাবে আগামী মঙ্গলবার। এস আলম গ্রুপ বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করছে, এটি তার প্রথম চালান। পর্যায়ক্রমে অন্য আমদানিকারকদের আমদানিকৃত পেঁয়াজ কার্গো উড়োজাহাজযোগে ঢাকায় পৌঁছবে। 


শনিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এর আগে গত শুক্রবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে টিসিবির মাধ্যমে সরাসরি তুরস্ক থেকে, এস আলম গ্রুপ মিসর থেকে, বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আফগানিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে জরুরিভিত্তিতে কার্গো উড়োজাহাজযোগে পেঁয়াজ আমদানি করবে। 

 

এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ বাজারে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এছাড়া সমুদ্রপথে আমদানিকৃত পেঁয়াজ বাংলাদেশের পথে রয়েছে, পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় চালান খুব শিগগিরই বাংলাদেশে পৌঁছবে।

এই বিভাগের আরো খবর