শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ইউএনও’র জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন শামীম ওসমান (ভিডিও)

প্রকাশিত: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪) : অন্তঃসত্ত্বার কারণে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসনে আরা বেগম বীনাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করায় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এমপিরা। এই ধরনের সিদ্ধান্ত বর্তমান নারী ক্ষমতায়নের যুগে একটি ভুল সিদ্ধান্ত বলেও মন্তব্য করেন তারা।

সোমবার জাতীয় সংসদে অনির্ধারণী আলোচনায় অংশ নিয়ে একথা বলেন তারা। এ সময়ে সংসদের সভাপতিত্বে ছিলেন ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া। স্পিকার নিজেও বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

শুরুতেই সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বিষয়টি সংসদে তুলেন। এরপর বক্তব্য রাখেন ওই এলাকার এমপি শামীম ওসমান।
বর্তমান সরকার নারী ক্ষমতার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে চুমকি বলেন, হোসনে আরা বেগম বীনা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। তার সহকর্মীরা কাজের প্রশংসা করেছেন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ৯ বছর পর মা হওয়ার আকাঙ্খা একজন নারীর চিরন্তন। সেই শিশুটিকে নিয়ে তার যে মানসিক অবস্থা তা নিশ্চয় আমরা উপলব্ধি করতে পারি। প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা এদেশের উন্নয়নে একটি বিরাট ধাপ অতিক্রম করেছেন নারীর উন্নয়নের মাধ্যমে। সেই লক্ষ্যে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। এজন্য বাংলাদেশে আজ নারী ক্ষমতায়নের মডেল।

নারী উন্নয়ন ও মাতৃত্বকালীন বিভিন্ন সুযোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, একজন নির্বাহী কর্মকর্তা, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্বে আছেন তিনি। সে যদি সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে থাকেন তাহলে সন্তান সম্ভবাকে কেন ওএসডি করা হলো? বিষয়টি আমাদের কাছে ক্লিয়ার নয়। তার পাশাপাশি আমি বলতে চাই একজন অন্তঃসত্ত্বা মায়ের সঙ্গে যে আচরণ করতে হয়, আমার মনে হয় সমাজ এখনও তা উপলব্ধি করতে পারেনি।
সন্তান সম্ভাবা নারীদের প্রতি অনেক গুরুত্ব দেয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। একজন সন্তান যদি সুস্থভাবে জন্মগ্রহণ না করে তাহলে শুধু মা নয়, আমাদের সমাজ ও দেশের জন্য বার্ডেন হতে পারে। এই ঘটনার জন্য একটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি করেন তিনি।

শামীম ওসমান (বক্তব্য হুবহু দেয়া) :

আপনাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ। আমাকে সুযোগ দেয়ার জন্য। আমি আরো ধন্যবাদ জানাচ্ছি মাননীয় সংসদ সদস্য। মেহের আফরোজ চুমকীকে। উনি যে বিষয়টি উত্থাপিত করেছেন সে বিষয়টির ঘটনা আমার এলাকার ইউএনওর সাথে ঘটনাটা ঘটেছে। আমি ওমরা হজ্বে ছিলাম। আমি ওমরা হজ্বে থাকা অবস্থাতেই এ ঘটনাটি শুনেছি। আমার নিজের বোনের সাথে কিংবা আমার পরম আত্মীয়ের সাথে যদি ঘটনাটি ঘটতো আমি যে দুঃখটুকু পেতাম ঠিক এক্ষেত্রে আমি ততটুকু দুঃখ পেয়েছি এবং লজ্জিত হয়েছি। তিনি আমার এলাকার সদরের ইউএনও।

আমি একজন সংসদ হিসেবে এটুকু সার্টিফাইড করতে চাই একজন সৎ, কর্মঠ অত্যন্ত ভালো একটা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে উনি আমার কাছে বারবার প্রতিয়মান হয়েছেন। 

এবং নির্বাচনের ঠিক আগমুহুর্ত্বে যখন অনেকেই চান তাদের নিজস্বমতো লোক নিয়ে এসে বসাতে। আমাকেও বলা হয়েছিলো। এই সময়ে এই মেয়েটি নির্বাচনের ঠিক আগ দিয়ে  তখন সে চারপাচ মাসের প্রেগনেন্ট আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আপনি পারবেন কিনা। যদি না পারেন তাহলে একটি ভালো জায়গায় পোস্টিং নেন। কারণ নির্বাচনের সময় অনেক ধরণের ঝামেলা হতে পারে। অগ্নি সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাস করতে পারে। উনি আমাকে আপীল করেছিলেন বরং আমি কাজটি করতে পারলে আমি সুস্থ থাকবো। আমি একজন বোনকে তাঁর ভাইয়ের বলা উচিৎ সেটিই তাকে বলেছিলাম, একটি শর্তে আপনি থাকতে পারেন। যে আপনি কোন অধিক পরিশ্রম করবেননা। আপনি চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করবেন। যেটুকু কাজ না করলেই হয় সেটুকু কাজই আপনি করবেন। কারণ এই বাচ্চাটি তাঁর ৯ বছরের চেষ্টার ফসল।

আমি খুব অবাক হলাম ও খুব লজ্জিত হলাম। আমার বোন মেহের আফরোজ চুমকি যেটি বলেছেন নারী সমাজের কথা। এই নারীই আমার মেয়ে, নারী স্ত্রী হয়, এই নারীই আমার মা। এটা মায়ের জাত। এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ জাতিটিকে সম্মানিত করেছেন। যে সুযোগ সুবিধাগুলো দিয়েছেন তা পৃথিবীর অনেক সভ্য দেশেও এ সুযোগ সুবিধা নেই। এখন আজ জনপ্রশাসন মন্ত্রী মহোদয়কে  সকাল থেকে বহুবার ফোন করেছিলাম। আমার নম্বরটা উনার কাছে নেই হয়তোবা। উনি রিসিভ করেননাই। কিন্তু আমার পুরো নারায়ণগঞ্জ এলাকায় এ বিষয়টা অনেক প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কেন, কি অপরাধে? যদি কোন অপরাধ হতো আমি নিজে জানতাম ওই বিষয়টা। কারণ আমি ওই এলাকার এমপি, আমার সদরেরই সে ইউএনও। আমিও আমার মাননীয় সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকীর সাথে উনি নারী হিসেবে বলেছেন, আমি মানুষ হিসেবে বলছি।

যে জাতি তাঁর নারী জাতিকে সম্মান দিতে জানেনা, সেই জাতি কখনো মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারেনা। তার শিক্ষা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদেরকে দিয়েছেন। আমি আশা  করি মাননীয় স্পিকার জনপ্রশাসন মন্ত্রী এ ব্যাপারে কথা বলবেন। এবং কার নির্দেশে ট্রান্সফার করতে এককথা, কার নির্দেশে এই মেয়েটিকে ওএসডি করা হলো, এবং ওএসডি করার পর মেয়েটি অসুস্থ হলো আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তাঁর বাচ্চাটা যাতে হায়াৎ দারাজ হয়। কিন্তু তাঁর বাচ্চার যেই শারীরিক অবস্থা তাতে আমি শঙ্কিত। যদি খারাপ কিছু হয় আল্লাহ মাফ করুক, তাহলে হয়তোবা আমি আমার নিজেকেও মাফ করতে পারবোনা। কারণ আমি ওই এলাকার এমপি ছিলাম।

মাননীয় স্পিকার আপনাকে ধন্যবাদ। আমাকে সুযোগ দেয়ার জন্য। আপনি একজন পিতা, আপনি একজন অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। প্রয়োজন হলে আপনিও আমার মনে হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রীকে বলতে পারেন এ বিষয়ে যদি আপনার কোন দিক-নির্দেশনা থাকে। ধন্যবাদ মাননীয় স্পিকার।  
 

জনপ্রশাসন সচিব :

কাজের চাপে নারায়ণগঞ্জের সন্তানসম্ভবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসনে আরা  বেগম বীনার অসুস্থতা আরও বাড়তে পারে সেজন্য তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মদ।

ওএসডি হওয়ার পর ইউএনও’র একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস ধরে প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে জনপ্রশাসন সচিব এ কথা বলেন। সচিব বলেন, ‘যে আদেশ আমার অনুবিভাগ করেছে তা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে আমি জাস্টিফাইড মনে করেছি, এটায় কোনো অন্যায় হয়নি, যথার্থ হয়েছে।’

গত ৪ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হোসনে আরা বেগমকে ওএসডি করে আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন হোসনে আরা। স্ট্যাটাসে তিনি সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর একজন বিশেষ কর্মকর্তা তাকে অযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে বদলির পাঁয়তারা করেই চলেছিল বলে দাবি করেন।

আমার সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল ২০ এপ্রিল, কিন্তু ওএসডি হওয়ার খবর শুনে প্রচ- মানসিক চাপে ফুসফুসে ব্লাড সার্কুলেশন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, ফলে পেটের সন্তানের অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় এবং হঠাৎ করেই পেটের বাবু নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় বলে জানান তিনি স্ট্যাটাসে।
৫ ফেব্রুয়ারি তার ৩১ সপ্তাহ বয়সী প্রি-ম্যাচিউর বাচ্চা সিজার করে বের করে ফেলা হয়। এখন সে স্কয়ার হাসপাতালের এনআইসিওতে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে বলে স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন তিনি।

‘এই নিষ্ঠুর অমানবিকতার পৃথিবীতে কোনো কর্তা ব্যক্তিদের কাছে আমি এ অন্যায়ের বিচার চাই না, শুধু আমার সৃষ্টিকর্তাকে বলব তুমি এর বিচার করো!!!’ স্ট্যাটাসে লেখেন সিনিয়র সহকারী সচিব হোসনে আরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার জনপ্রশাসন সচিব বলেন, ‘কিছুদিনের মধ্যে উপজেলা নির্বাচনের তফসিল  ঘোষণা হবে বিষয়টি জেলা প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয় অবহিত হয়েছে। মেয়েটি গর্ভবতী কিন্তু অসুস্থ। যখন আদেশটি হয় তখন আমি ওমরায়। ঘটনা শুনে আমি অফিসারদের ডাকি কী কারণে হয়েছে। উপ-সচিব পর্যন্ত সব সিদ্ধান্ত এপিডি (নিয়োগ পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব) নিতে পারেন এবং উনি এটা করেন।’
ফয়েজ আহম্মদ বলেন, ‘মন্ত্রণালয় মনে করেছে যে সামনে নির্বাচন কিন্তু চ্যালেঞ্জিং। আর সাধারণত গর্ভাবস্থার প্রথম সময়টা এবং শেষ সময়টায় প্রবলেম হয়, মাঝখানটা ভালো থাকে। মেয়েটা নিজেই স্বীকার করেছেন উনি অ্যাজমার রোগী এবং ঢাকায় চেকআপে যান।’

তিনি বলেন, ‘এই মায়ের প্রতি এবং তার বাচ্চার প্রতি আমাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং পুরো ভালোবাসা রয়েছে। এই বিবেচনায় মনে করা হয়েছে যে চ্যালেঞ্জিং জবের সময় যদি এই চাপ তার অসুস্থতা আরও বাড়িয়ে দেয় এজন্য তাকে ওএসডি করে ঢাকায় রাখা হয়েছে এবং তিনি ঢাকায় ট্রিটমেন্টে আছেন।’
নির্বাচনের সময় একটা উপজেলা খালি রাখা সম্ভব কি-না প্রশ্ন রেখে সচিব বলেন, ‘তার যদি এতই আগ্রহ থাকে তবে মাতৃত্বকালীন ছুটির পর তাকে আবার ওই দায়িত্বে পাঠাব।’

তিনি বলেন, ‘বদলির এখতিয়ার এপিডির হাতে, যদি অবিচার হয়ে থালে সে সচিবের কাছে আসতে পারে। মন্ত্রণালয় ভালো করছে না বলে মনে করলে তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। মুখ্য সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, সেই সুযোগ ছিল।’
‘বাস্তবতা হলো, যেখানে বিধিবদ্ধ অথরিটি আছে সেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এটি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে আমি জানি না’-যোগ করেন ফয়েজ আহম্মদ।

সচিব আরও বলেন, ‘একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তিনি নিজে নিজে এটা করেছেন কি-না, আমি সন্দেহ পোষণ করি। তাকে কেউ বিপথগ্রস্থ করার জন্য করল কি-না? আমাদের অথরিটিকে কেউ অসম্মান করার জন্য কেউ করেছে কি-না আই ডোন্ট নো।’

এ বিষয়ে কথা বলতে হোসেনে আরা বেগম বীনা মুঠোফোনে কল দেয়া হলে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।


 

এই বিভাগের আরো খবর