শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

চাল নিয়ে আড়তদারদের চালবাজি

প্রকাশিত: ২৩ মার্চ ২০২০  

যুগের চিন্তা রিপোর্ট : চলছে চাল নিয়ে চালবাজি! বর্তমানে এই বাক্যটিই যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষের জন্য। করোনা ভাইরাসে মানুষের আতঙ্ককে পুঁজি করে চাল ব্যবসায়ীরা দ্বিগুণ দাম হাঁকাচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত, জরিমানা, প্রশাসনের চোখ রাঙানিতেও ভ্রুক্ষেপ নেই ব্যবসায়ীদের। 

 

মাত্র এক কেজি মোটা চাল কিনতেই পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা। এছাড়া গরিবের চাল খ্যাত স্বর্ণা, গুটি ও আটাশ মোটাচাল মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ থেকে ৪৮ টাকা। চলতি সপ্তাহে সদর উপজেলা ইউএনও নাহিদা বারিক নিতাইগঞ্জে অভিযান পরিচালনার পর আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সেখানকার চাল ব্যবসায়ীরা। দাম নিচ্ছেন নিজেদের মর্জি মতো।

 

সরেজমিন এই প্রতিবেদন করার সময় ওই এলাকার ধান-চাউল আড়তদার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির নেতারা সাংবাদিকদের উপর চড়াও হন। এসময় তারা ইউএনও, প্রশাসন এবং সাংবাদিকদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। রোববার নারায়ণগঞ্জের পাইকারি চালের আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, চাল নিয়ে চালবাজির নানা চিত্র। কোনো দোকানে দামের ফোঁয়াড়া, কোনো দোকানে আবার অভিযোগের। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ‘করোনা নয় ক্রেতাদের তৈরি কৃত্রিম আতঙ্কের কারণেই চালের দাম বেড়েছে। 

 

ব্যবসায়ীরা জানান, এক সপ্তাহের যা বিক্রি না করি তা এই ৩-৪দিনে মধ্যে বিক্রি করেছি। যেখানে এক বস্তা প্রয়োজন সেখানে ৩-৪ বস্তা করে ক্রেতারা ক্রয় করছে। ফলে চাহিদার বৃদ্ধি হচ্ছে। আর এ চাহিদাকে পুঁজি করেই ধান ব্যবসায়ী, চালের ব্যাপারীরা দাম বাড়াচ্ছে। এটা শুধু আমাদের এখানে না দেশের সকল জায়গাতেই। এখানে আমাদের কোনো দোষ নাই।’ 

 

পাইকারি দোকানে নেই কোন মূল্যতালিকা। এবিষয়ে তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উত্তর দেন, ‘যখন ঝুলাবার তখন ঝুলাবো।’ বাকি পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরা ছিলেন আরো আক্রমণাত্মক। 

 

অন্যদিকে চালের খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছে ভিন্নকথা। মূলত পাইকারি চাল আড়তদাররা ক্রেতাদের চাহিদাকে পুঁজি করেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালের দাম বাড়িয়ে চলেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা যখন তাদের নির্ধারিত করা দামে কিনতে হয় তখন তো স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বাড়তি দামে বিক্রি করতে হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় যথাযথ উদ্যোগ না থাকায় এ ধরনের সাহস তারা পাচ্ছে। তারা তো আমাদের মানুষই মনে করছেনা এখন, ব্যবসা তো দূরের কথা। 


এদিকে পাইকারি চালের দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ দোকানেই নিজেদের ইচ্ছেমত চালের দাম নির্ধারণ করা। একই ধরনের চালে দোকানভেদে কেজিপ্রতি ২ থেকে ৩ টাকা করে বাড়তি আদায় করা হচ্ছে। যেমন, মের্সাস নিউ এফ করিম রাইছ এজেন্সী বাসমতি চাল ৫৬ টাকা, মিনিকেট ৪৮ থেকে ৫০, নাজির শাইল ৪৯, লতা ৩৭,স্বর্ণা (পাইজাম স্বর্ণা ৩৪, গুটি স্বর্ণা ৩২) ৩২ থেকে ৩৪ টাকা দরে বিক্রি করছে।

 

আবার জিলানী রাইছ এজেন্সি কাটারী চাল থেকে বাসমতি, লতা, নাজির শাইল, মিনিকেট, স্বর্ণা, আতশ ৫০ টাকা  কেজি দরে বিক্রি করছে। তবে বস্তাপ্রতি  বাসমতি ২৫৭০, লতা ১৭০০-১৮০০ টাকা, নাজির শাইল ২৩৯০-২৪০০ টাকা, মিনিকেট ২৪৫০-২৪৮০ টাকা, আতশ ১২৪০ টাকা দরে বিক্রি করছে।

 

আড়তদাররা বলছে, গত কয়েকদিনের ব্যবধানে চালের বাজারের এ অবস্থা। গত সপ্তাহেও আমরা যে চালের বস্তা মিল মালিকদের কাছ থেকে কিনেছি ১৫০০ থেকে ১৮০০টাকা। এখন তা কিনছি ১৯০০-২১০০ টাকা করে। মিল মালিকদের নির্ধারিত দামের ওপর কমিশনের ভিত্তিতে চাল বিক্রিও করতে হয়। এখন মালিকরা যদি বাড়ায় তাহলে আমাদের ক্রয়, পরিবহন ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক খরচ সব মিলিয়ে যে খরচ হয় তা ওঠাতে আমাদেরও বাড়াতে হয়।  

 

অন্যদিকে এএমকে রাইছ এজেন্সিতে কেজি প্রতি লতা ৪১, পারিজা ৪১-৪০, পাইজাম ৪০,নাজির ৪৮,মিনিকেট ৫২-৫৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এম কে রাইছ এজেন্সির ম্যানেজার সুভাস দেব জানান, আমরা মূলত পাড়া-মহল্লার খুচরা দোকানীদের কাছে চাল বিক্রি করি। গত তিনদিনে আমরা প্রায় বিক্রি করেছি এক সপ্তাহের যে পরিমাণ চাল বিক্রি করি। এক সপ্তাহে আমাদের বস্তা বিক্রি হয় ৩ থেকে ৩৫০০। তাহলে বুঝুন কী পরিমাণ চাহিদা ছিলো। আর এই চাহিদার কারণেই সঙ্কট সৃষ্টি হয়। আজকে থেকে আবার  চালের বাজার কিছুটা স্বাভাবিক। বস্তাপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে। সামনে আরো কমবে।

 

পাশেই মের্সাস সোহান ট্রেডিং এ মিনিকেট কেজি প্রতি ৫২ টাকা, নাজির শাইল ৫১ টাকা ও লতা ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মের্সাস সোহান ট্রেডিং এর ম্যানেজার মো.বাবুল জানান, আমরা এখান থেকে পাইকারি দরে কিনে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করি। এখন পাইকারি দরে বাড়লে আমাদেরও বাধ্য হয়ে বাড়াতে হয়।  

 

এদিকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের বাজার। গত কয়েক দিন ধরে চালের দাম বাড়া-কমার প্রতিযোগিতায় বেসামাল হয়ে পড়ছে খুচরা বিক্রেতা ও সাধারণ মানুষেরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন খুচরা ব্যবসায়ী জানান, শুধু তো চাল না; ডাল, তেল, ময়দা কোনোটাই বাদ নেই। যে মুসুরের ডাল গত দুই দিন আগেও ৬০ টাকা করে বিক্রি করেছি সে ডাল এখন ৬৫-৭০ টাকা দরে বিক্রি করছি। খেসারী বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা। তেল লিটার প্রতি ২-৩ টাকা করে বেড়েছে। চালের কথা তো বাদই দিলাম।

 

তিনি বলেন, ‘শুনেছি  দুইদিন আগে  ম্যাজিস্ট্রেট এসে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে গেছে। তা সত্ত্বেও কীভাবে এমন লাগামহীনভাবে দাম বাড়ায়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা নিয়ে সন্দেহ হয় এখন। অভিযান পরিচালনা করে নাকি শুধু পকেটভারি করে দৌঁড় দেয়, নাকি ঘুষ খায়। নিয়মিত এবং যথাযথভাবে যদি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হত তাহলে আজকে এমন দিন দেখতে হত না।’

 

অন্যদিকে, চালসহ অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের আকাশচুম্বি দরদামে সাধারণ মানুষের আল্লাহই ভরসা! এমনটাই বলছে জনসাধারণ। চাল কিনতে আসা চাকুরীজীবী মহিন মোল্লা জানান, গত ১৫ দনি আগে যে চালের বস্তা নিয়েছি ১৫০০ টাকায় এখন ২১০০ টাকায় বিক্রি কিনতে হচ্ছে। তার ওপর দোকানদাররা বলছে ‘৫০ টাকা কম রাখছি’।

 

রিকশাওয়ালা সামাদ মিয়া জানান, ‘আল্লাই ভরসা। যা হবার হইবো। আল্লায় মুখ দিছে আল্লায়ই খাওয়াইবো।  আমাগো কি করার আছে।’

 

এ বিষয়ে ধান চাল আড়ৎদার  ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি হাজী মো.আক্কাছ আলী মোল্লা জানান, মূলত চাহিদার কারণেই দামের এমন উঠানামা। একটু লক্ষ্যে করে দেখবেন গত তিনদিনে যে পরিমাণ চাল আমরা বিক্রি করি আমরা সেই পরিমাণ চাল বিক্রি করি সপ্তাহে। এখন আমরা প্রতিদিন যেখানে ২০০ থেকে ২৫০ বস্তা চাল বিক্রি করি সেখানে যদি ১ হাজার থেকে দেড় হাজার বস্তা চাল বিক্রি করি সেখানে চাহিদা অনুযায়ী যোগান দিতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। আর তখনই মিল মালিকরা দাম বাড়িয়ে দেয়।

 

তিনি আরও জানান, দোকানভেদে দামের যে হেরফের তা মূলত চালের মানভেদে তৈরি হয়। মান অনুযায়ী দাম রাখা হয়। এখন ভালো জিনিস কিনতে গেলে দাম তো কিছুটা বাড়তি গুণতে হবেই।

 

চাল আড়তদারদের লাগামহীন দাম বাড়ানোর প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা বারিক জানান, এই মুহূর্তে কোনভাবেই চালসহ নিত্যাপ্রয়োজনীয় কোন পণ্যের দামই বাড়ানো যাবেনা। বাজার নিয়ন্ত্রণে আমরা মাঠে কাজ করছি। চাল আড়তদারদের সতর্ক করে এসেছি। সেটি না শুনলে কঠোরভাবে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এই বিভাগের আরো খবর