শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

অসৎ বন্ধুর ফাঁদ

প্রকাশিত: ২২ জুলাই ২০১৮  

সাহিত্য ডেস্ক(যুগের চিন্তা ২৪) :  
সাঈদ দেলোয়ার


বুবলিটা কি আজও আমায় ঘৃণা করে?
হাসপতালের বেডে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো সাহেল।
ঘৃণা তো করবেই,যার জীবনে কোনো ভালো দিক নেই তাকে তো ঘৃণাই করা উচিত।


মাঝে মাঝে এই হাসপাতালের বসবাস করা জীবন থেকে পালিয়ে একবার বুবলির কাছে যেতে ইচ্ছে করে।জানতে ইচ্ছে করে আজও বুবলির পুরো হৃদয় জুড়ে সাহেল আছে কিনা!

 

সাহেল ফিরে যায় সেই দিনটির স্মৃতি চারণে।
দশম শ্রেণীর টগবগে উচ্ছ্বাসিত বুবলি যেদিন প্রথম সাহেলদের বাড়ির নিচতলায় ভাড়াটিয়া হয়ে এলো।
সাহেল তো প্রথম দেখাতেই চোখদুটো ছানাবড়া।এতো সুন্দর মোহণীয় দৃষ্টি আর গালের দুপাশে দুটো পাগল করা টোল।আহা!
মনটা একনিমিষেই হরণ করে নেয়।


সাহেল তখন সবে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান সে,কোনো কিছুরই অভাব নেই। দুটো ঠোঁটে একটা বাক্য বলার আগেই সব হাজির করে দেয় বাবা,আর মাতো তুলনাহীন। সাহেল বরাবরই একটু ফূর্তীবাজ ছেলে,সেই সূত্র ধরেই কলেজে ওর প্রচুর বন্ধু। সকলেই বাড়ি আসে ওদের,আড্ডা দেয়, খাওয়া দাওয়া সব কিছু করেই রোজ ওর বন্ধুরা বাড়ি ফেরে। তেমনই একটা আড্ডার দিনে সাহেলের বন্ধু জনি আসে  ওদের বাড়িতে। আড্ডার এক পর্যায়ে জনি বলে একটু ছাদে খোলা হাওয়ায় ঘুরে আসি।


মনটা ফ্রেশ করতেই ছাদে যায় জনি। গিয়ে তো অবাক,এ মা! সাহেলের বাড়ির বাগানে এতো সুন্দর একটা মন হরণ করা গোলাপ আছে,সাহেল তো বলেনি।
এগিয়ে যায় জনি, আস্তে আস্তে।


বুবলি তখন সাহলের লাগানো গাছগুলিতে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে চলছিল। বুবলি বুঝতেও পারেনি তার পেছনে একজোড়া অসভ্য চোখ লোলুপ দৃষ্টি মেলে তার শরীর গিলে খাচ্ছে। পেছন  থেকে জাপটে ধরে জনি, বুবলিকে। বুবলি হঠাৎ এধরনের ঘটনা বুঝতে পারেনা।কারন,সাহেলকে বুবলিও মনে মনে ভালোবাসে। কিন্তু সে তো মনে মনে,প্রকাশ করাও হয়নি।তাহলে সাহেল কেন ওর স্পর্শ পেতে মরিয়া হয়ে উঠবে। ঘটনার রেশ কাটতেই বুবলি চিৎকার করে ওঠে,ছাড়ুন ছাড়ুন!


জনির বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে সাপের মত ফোঁস ফোঁস করে ওঠে বুবলি। সাহেলও জনিকে নাস্তা খেতে ডাকার জন্য ছাদে আসে ঐ সময়।এসে দেখে বুবলি  ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আর জনি তখনও ওর অসভ্য দৃষ্টি মেলে নোংরা হাসি হাসছে। সাহেল প্রথম কথা বলল বুবলির সাথে। কি হয়েছে আপনার?
কাঁদছেন কেন?
জনি তুই কি করিস এখানে?


সাহেলের কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় বুবলি,এক ছুটে সাহেলের বুকের মাঝে নিজের আশ্রয় খুঁজে নেয় বুবলি। কিন্তু কিছুই বলতে পারেনা।
সাহেল অবাক হয়ে যায়,কি বলবে বুঝতেই পারেনা। পরম মমতায় বুবলির মাথায় হাত বোলাতে থাকে। কান্না থামিয়ে নিজেকে সামলে নেয় বুবলি,তারপর বলে , আপনার বন্ধু আমাকে অপমান করেছে। আমাকে পেছন জড়িয়ে,,,,


সাহেলের শরীরের রক্ত টগবগ করে উঠলো।
বুবলিকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে জনির গালে কষে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিল।


ছিঃ জনি, তোকে আমার বন্ধু ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে। চলে যা তুই আমার সামনে থেকে,আর কোনদিন আমাদের বাড়িতে আসবি না। জনি মাথা নিচু করে হনহন করে চলে গেল সাহেলদের বাড়ি থেকে। বুবলিকে সাহেল অনেক বুঝিয়ে কান্না থামালো, সেদিন আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া হলোনা। সবাইকে ভালো লাগছে না বলে বিদায় দিলো।


রাতে পড়ার টেবিলেও মন লাগলো না সাহেলের।ভাবলো ছাদ থেকে ঘুরে আসি।।
গিয়ে দেখে বুবলি খোলা চুলে ছাদের কার্নিশে মাথা গুজে বসে আছে, সাহেলের মনে হলো একটা কান্নার শব্দ আসছে কোথাও থেকে। সাহেল এগিয়ে গেলো বুবলির কাছে,আপনি এখানে??


বুবলি মাথা উঁচু করলেই সাহেল বুঝতে পারলো কান্নার শব্দ কোথা থেকে আসছিল।
সাহেল নিজেকে অপরাধীর আসনে বসিয়ে লজ্জিত মুখে বুবলির সামনে বসলো।
প্লিজ বুবলি,আমায় ক্ষমা করবেন।


আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন, অপরাধী তো আপনার বন্ধু। আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন?আসলে জনির মানসিকতা এতোটা নোংরা আমি বুঝতে পারিনি, সরি আমার এ অদূরদর্শীতার জন্য। একথা সেকথা বোঝাতে বোঝাতে বুবলি সাহেল একে অপরের  সংকীর্নতা চলে গেলো।


সাহেল ভাবলো
★ বলেই ফেলি আজ
ভেঙে সকল লাজ
ভালোবাসি কন্যা তোমায়★
ভাবা মতোই কাজ সাহেল বলেই ফেলল, বুবলি
আমি অনেক অনেক বার ভেবেছি আপনাকে একটা বলি। কিন্তু শুরুটা করতে পারছিনা।

 

কি কথা বলুন।
মানে কথাটা আপনি কিভাবে নেন!বুবলি বলল আচ্ছা
এতো ভণিতা না করে বলে ফেলুন।


আসলে প্রথম দেখাতেই আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। বুবলিও কিছুই না বুঝে বলে ফেলল, আমিও আপনাকে খুব পছন্দ করি,সেই প্রথম দেখা থেকে।

মিষ্টি মধুর আলাপনে বুবলি সাহেলের দুটি হৃদয় একটু একটু করে একে অপরের কাছে চলে এলো।

 

ভালোলাগা,ভালোবাসা আর মধুর আলাপনে দুটো পবিত্র হৃদয় ভালোবাসার সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলো।
কলেজ, কোচিং আর বুবলি এই রুটিনেই চলছিল সাহেলের জীবন।
মাকেও বলেছিল আমি বুবলিকেই চাই,আমার জীবনে।
মা খুব পছন্দ করতেন বুবলিকে।
দুটো পরিবারের মাঝে কথাও ঠিক হলো,লেখাপড়া শেষ হলে ওদের দুজনার হাত এক করা হবে।

 

কিন্তু কিছু ভুল কিছু ধ্বংসের জন্ম দেয়,,
আর সেই ভুলটি করেছিল সাহেল
তার বন্ধু জনির অপরাধের জন্য একটি থাপ্পড় দিয়ে।

 

বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ জনির সাথে দেখা সাহেলের।
জনি যেন সাহেলকে দেখে বিগলিত হয়ে গেলো।
দোস্ত, সেদিনের ব্যবহারে আমি লজ্জিত। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা কর প্লিজ।

সাহেলও কিছুই না ভেবে বন্ধুকে মাফ করে দিল।

 

একদিন কলেজ থেকে বেরিয়ে সাহেল মোটরসাইকেল স্টার্ট দিচ্ছে, এমন সময় জনি হাজির।
বন্ধ চল ঘুরে আসি একটু।

 

বেশ চল!!
সাহেল আর জনির ঘনিষ্ঠতা আবার বেড়ে চলল, প্রতিদিন দুজন বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে যেত।
আর এই একসাথে থাকাকে কেন্দ্রই একটু একটু করে জনি, সাহেলের জীবনটাকে নরক বানাতে বসেছিল।
জনি খুব নোংরা মানসিকতার ছেলে,সাহেলের উপর রাগের বশবর্তী হয়েই সে চেয়েছিল তাকে নষ্ট করতে।
আর তাই প্রথমে তাকে সিগারেট মুখে না দিলে ছেলেদের স্মার্ট লাগেনা এটা বোঝালো। আরে দোস্ত, তোর বুবলিও তোকে চয়েজ করবেনা যদি না তুই পুরুষ হয়ে উঠিস।


সাহেলও আগে পিছু ভাবলো না,সিগারেট এর নেশায় পড়লো।
এরপর জনি বোঝালো, তুই কি জানিস
শরীরে একটা ঔষধ পুঁশ করলে দুনিয়ার সব কিছু সুন্দর মনে হয়। তোর সুন্দরী বুবলিকে তোর কাছে মনে হবে, স্বর্গের হুর।
প্রতিদিনই যেন জনি নতুন নতুন একটা খবর আনতো, যা সাহেলকে মন্ত্র মুগ্ধ করে ফেলতো।
আস্তে আস্তে এই নেশার ঘোরে পড়ে গেলো সাহেল,বুঝতেই পারলো না। বুবলি ও চিন্তিত ছিল সাহেলের ব্যবহারে , হাজার প্রশ্ন ও করত 
কি ব্যপার সাহেল,তোমাকে আজকাল ঠিকমত পাওয়া যায়না, চেহারা ও অন্যরকম লাগে।
বলো আমাকে!
আরে বোকা কিছুই না।


তুমি কি জানো দিন দিন তুমি কতোটা সুন্দরী হয়ে যাচ্ছো?
ধ্যাৎ!!
লজ্জায় লাল হতো বুবলি।


মা আর বাবাও চিন্তিত ছিলেন সাহেলকে নিয়ে, কিন্তু বুঝতে পারতেন না কি বলে শুরু করবে কথা।
সাহেলকে আজকাল কোনো ভালো কথাও বলা যায়না,সাথে সাথে মেজাজ দেখাতো।
লেখাপড়ায় ও মন ছিলনা সাহেলের,এটা ও বাবা মা বুঝতে পারছিলেন।

 

একদিন রাতে সাহিলের ঘর থেকে প্রচুর শব্দ আসছিল। মা ঘুম থেকে উঠেই সাহেলের ঘরে দৌড়ে গেল, গিয়ে দেখে সাহেল মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
মা চিৎকার করে উঠলেন,সাহেলের বাবা দ্রুত এদিকে এসো। আমার সাহেল কেমন করছে।


সাহেলকে হাসপাতালে নেওয়া হলো,কিন্ত ডাক্তার সাহেলকে দেখে যা বললেন
তাতে বাবা হিসেবে সাহেলের বাবার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।
আপনার ছেলের চিকিৎসা এখানে হবেনা,তাকে মাদকাসক্ত ট্রিটমেন্ট সেন্টারে নিতে হবে।
কি..?


মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন সাহেলের বাবা মা।।
চোখে অন্ধকার দেখছিলেন তারা।
সেদিনই সাহেলকে নিয়ে আসা হলো উন্নত চিকিৎসার জন্য "মাদকাসক্ত ট্রিটমেন্ট সেন্টারে"।

 

ডাক্তার সাহেলের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললেন,অনেক দেরী করে ফেলেছেন আপনারা। আমাদের কিছুই করার নেই,কারন সাহেলের শরীরে HIV  ভাইরাস এর জীবানু পাওয়া গেছে।একটা নেশার সূঁচ  অনেকে মিলে শরীরে পুঁশ করার জন্যই আজ ওর এই পরিণতি।

সেদিন থেকেই সাহেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এসব খবরে বুবলির বাবাও বাড়ি পাল্টিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন সবাইকে নিয়ে। বুবলির কোন কথার মূল্যই রইল না, না মূল্য রইল বুবলির চোখের পানির।
আজ কতোদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে, শুধু বুবলির মুখটা ভেসে ওঠে সাহেলের চোখে।
মাকে বুবলির কথা জিগ্যেস করলেই বলে


আসবে বাবু আসবে।ওর পরীক্ষা তো, তাই আসতে পারছেনা।
আজ খুব কষ্ট হচ্ছে সাহেলের, বারবার বুবলির স্মৃতি ওকে তাড়া করছে।
মা বসে আছেন সাহেলের পাশে, ডাক্তার ও এসেছেন।


মাঝরাতে ভুল বকতে শুরু করলো সাহেল, মা খুব কান্নাকাটি করছেন সাহেলের পাশে বসে।
বাবা আর দেখতে পারছেন না ছেলের কষ্ট। এক ছুটে বাইরে চলে গেলো বাবা, সারারাত যমে মানুষে টানাটানি চললো।
ফজরের আযান এর সময় সাহেল একবার শুধু চোখ মেলে মাকে বললো
মা!!


বুবলিকে বলবে
ওকে আমি সত্যিই খুব ভালোবাসতাম।আমি ভুল করেছি, নোংরা বন্ধুকে আবার জীবনে ফিরিয়ে এনে।আমার মতো কেউ যেন তার জীবনে, বন্ধু চিনতে ভ্লু না করে। ভুল বন্ধুর ফাঁদে পড়ে ধ্বংস না হয়ে যায়।

 

শেষ রাতে সাহেলের মৃত্যু হলো মায়ের কোলের উপরে মাথা রেখে।।
তখন যে সুন্দর একটা সকাল ছিল, স্মরণীয় একটা দিন ছিল সাহেলের জীবনে।।
আজ যে সাহেলের জন্মদিন।

সাহেল আজ নেই আজকের দিন আর সাহেল শুধুই স্মৃতি হয়ে রইল।