মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ৫ ১৪৩০

মনসা পূজা আজ

প্রকাশিত: ১৮ আগস্ট ২০১৯  

বনের আগুন থেকে মনের আগুন ভয়ংকর। হিংসুক জ্বলে মরে হিংসার আগুনে। জ্ঞানীদের এই চিরন্তন সত্যকে সামনে রেখে আমরা আমাদের আত্মার প্রেম দিয়ে জগতের কল্যাণ বয়ে আনতে পারি। প্রেমময় স্রষ্টার সৃষ্ট এ পৃথিবীতে প্রেম যখন পূজার রূপ নেয়, তখন পৃথিবী হয়ে ওঠে আলোকোজ্জ্বল শান্তির আধার। পদ্মা পুরাণ বা মনসা মঙ্গল কাব্যে তাই তুলে ধরা হয়েছে।


মনসা হচ্ছে সর্পের দেবী। দেব-দেবীকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। মনসা লৌকিক দেবী। অতি প্রাচীনকালে, বিশেষ করে গুপ্ত রাজত্বে বাংলাদেশ আর্য-উপনিবেশ স্থাপিত হয়। আর্যরা ছিলেন চিন্তাশীল, আদর্শবাদী, সংযমনিষ্ঠ ও অধ্যাত্মপরায়ণ। তারা দেব-সেবা ও যজ্ঞানুষ্ঠান করতেন। সে সময় একেক জন একেক শ্রেণির দেব-দেবীর পূজা করতেন। কেউ বৈদিক, আবার কেউ বা পৌরাণিক। অষ্টম শতকে পাল রাজগণ বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। এ সময় বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীকালে সেন রাজগণের আমলে শৈব, বৈষ্ণব, বৌদ্ধতান্ত্রিক, ব্রাহ্মণ্য প্রভৃতি ধর্মমত প্রচলিত হয়। এতে করে উপাসদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়।

 

দ্বাদশ শতকের শেষের দিকে বাংলায় তুর্কী আগমন শুরু হয়। এ সময় বাংলার পলি মাটিতে নব রূপায়ণ হয়। হিন্দু সনাতন ধর্মের। লৌকিক দেবী মনসার পাঁচালী অপৌরাণিক পাঁচালী হিসেবে গড়ে ওঠে। সেখানে শৈব শিব উপাসক চাঁদ সওদাগর মনসার বিরোধী ছিলেন। চাঁদ সওদাগর মনসা পূজা না করলে মানব কূলে কেউ মনসার পূজা করবে না- এ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় মনসার সাথে। 


সেই বিরোধের কারণে মনসা একে একে চাঁন্দের ছয় ছেলেকে সাপ দিয়ে দংশন করে। ছয় বিধবা পুত্রবধূ নিয়ে চাঁদ সওদাগর মনসার প্রতিহিংসার শিকার হন। চাঁদ সওদাগর ও মনসাকে হিংসা করেন। সে কারণে চাঁদ সওদাগর মহাজ্ঞান হারান, বন্ধু শঙ্কু গাড়–রী অকালে মারা যান। সাগরে চৌদ্দ বাণিজ্য ডিঙ্গা ডুবে যায়। চাঁদ সওদাগর প্রাণে বেঁচে রইলেন মাত্র। তারপরও তার হিংসা দূর হলো না ! 


এদিকে মনসা তার পূজা লাভের আশায় স্বর্গের অনিরুদ্ধ ও উষাকে মর্ত্যলোকে নিয়ে এলেন। চাঁদপুত্র লক্ষীন্দর সায়বেনের মেয়ে বিপুলা।বাসর ঘরে সর্প দংশনে লক্ষীন্দরের মৃত্যু হয়। স্ত্রী বিপুলা মৃত স্বামীকে নিয়ে ভেলাযোগে স্বর্গ গমন করেন। সেখানে সতীত্ববলে স্বামীকে পুনঃজীবিত করে, ছয় ভাসুর এবং চৌদ্দ বাণিজ্য নৌকা নিয়ে মর্তে ফিরে আসেন। সবার অনুরোধে পরিশেষে চাঁদ সওদাগর মনসা পদ্মাদেবীর পূজা করেন। লক্ষীন্দর ও বিপুলা শাপ মুক্ত হয়ে স্বর্গে চলে যান। 

 

চমৎকার এই কাহিনী নিয়ে সুকবি নারায়ণ দেব ও প-িত জানকী নাথ পদ্ম পুরাণ লিখেছেন। যা পৌরাণিক কাহিনী হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। এত করে লৌকিক দেবী পৌরাণিক দেবীর আসন দখল করে নিয়েছেন। পদ্ম পুরাণ বা মনসা মঙ্গল কাব্যে দু’টি অংশ রয়েছে। প্রথম খন্ড দেব খন্ড। এরপর রয়েছে বানিয়া খন্ড। হরিশায়নের পর পঞ্চমীতে মনসা পূজা বিধেয়। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গে শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতেই মনসা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। 

 

কোন কোন স্থানে এক মাসব্যাপী মনসা মঙ্গল কাব্য গীতি গান করা হয়। বাংলাদেশে রচিত মনসা মঙ্গল রচয়িতার মধ্যে বিজয় গুপ্ত সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। রচনাকাল ১৪৯৪-১৪৯৫ খ্রীস্টাব্দ। এরপর হরিদও মনসা মঙ্গল কাব্য লিখেছেন। ষোড়শ শতকে রচিত হয় দ্বিজবংশী দাসের মনসা মঙ্গল। এখানে বিপুলার (বেহুলা) সিথির সিঁদুর মুছতে পারেনি কালো নাগ। চাঁদ সওদাগরের হিংসা-ঘৃণা পরিশেষে প্রেম-পূজায় রূপ নিয়েছে এ মঙ্গল কাব্যে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে আমরাও প্রেমকে পূজা ও পূজাকে সেবার রূপে রূপায়িত করে আমাদের কল্যাণময় দেশ গড়তে পারি। কালো নাগের বিষ অমৃত হোক! সবার মঙ্গল করুন মঙ্গলময়ী মনসা।

 

রণজিৎ মোদক  
লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি, ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব